প্রেয়সী || পার্ট: ২ || লেখিকা: সুলতানা তমা
উঠোনের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জায়গায় চেয়ারে বসে আছি, পাশে তনিমা বসে আছে অন্য চেয়ারে। বাড়ির ভিতর কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে এইটা বেশ বুঝতে পারছি অর্পিতা আমাদের বাসায় যেতে চাচ্ছে না। তাছাড়া এটাই তো স্বাভাবিক যাকে ভালোবাসে তাকে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে যাবে কিভাবে?
তনিমা: ভাইয়া কি ভাবছিস? (আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ তনিমার কথায় আমার ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো)
আমি: কিছু নাতো।
তনিমা: এক মুহূর্তে সবকিছু কেমন উলটপালট হয়ে গেল তাই না?
আমি: (নিশ্চুপ)
তনিমা: চাচ্চু নিজের জিদ জিতাতে গিয়ে তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলো। একদিকে মেয়েটা হিন্দু অন্যদিকে আবার সে অন্য কাউকে ভালোবাসে, আমিতো বুঝতেই পারছি না কি হবে সামনে। (সত্যি তো কি হবে ভবিষ্যৎ এ? ডিভোর্স ছাড়া তো আর কোনো রাস্তা দেখছি না আমি। হুট করে বিয়েটা হলো আবার ডিভোর্সও হয়ে যাবে, সবকিছু কেমন যেন পুতুল খেলার মতো মনে হচ্ছে)
তনিমা: আমি ভাবছি বাসায় যাওয়ার পর কি হবে। চাঁচি তো ধর্মভীরু মানুষ, সবসময় নামাজ পড়েন আর উনার বৌমা কিনা হলো একজন হিন্দু মেয়ে? খুব বড় ঝামেলা হবে দেখে নিস।
আব্বু: কিচ্ছু হবে না, আমি সব সামলে নিবো আমার উপর ভরসা রাখ তোরা। (আব্বু আর অর্পিতার মামা এসেছেন দেখে উঠে দাঁড়ালাম। একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মনে হচ্ছে আব্বুকে প্রশ্নটা করা খুব জরুরী)
আব্বু: আয়া…
আমি: আব্বু বিয়েটা তুমি কেন দিয়েছ? শুধু কি অর্পিতা লগ্নভ্রষ্টা হবে বলে নাকি অন্য কোনো কারণে? এমন নয়তো সবকিছু তোমার প্ল্যান করা ছিল? (আমার প্রশ্ন শুনে আব্বু কিছুটা বিব্রত হয়ে গেলেন, খানিকক্ষণ পরই নিজেকে সামলে নিয়ে আমার দিকে রাগি চোখে তাকালেন)
আব্বু: কি বলছ এসব? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? আমার ছেলের বিয়ে আমি প্ল্যান করে এভাবে দিতে যাবো কেন? এইটা শুধুমাত্র পরিস্থিতি…
আমি: বাসায় ফিরছি কবে? (আব্বু চেঁচিয়ে কথা গুলো বলছিলেন, আমার প্রশ্ন শুনে শান্ত হলেন)
আব্বু: আজ রাতে আর আমরা যাচ্ছি না। অর্পিতা যেতে চাচ্ছে না তাছাড়া অনেক রাত হয়ে গেছে তাই ভাবছি সকালে যাবো।
আমি: তোমার এখানে থাকতে হয় থাকো কিন্তু আমি থাকবো না, আসছি আমি।
আব্বু: কোথায় যাচ্ছ? বাসায়? তোমার আম্মু তো হাজারটা প্রশ্ন করবে তোমাকে একা দেখলে।
আমি: আর আমার সঙ্গে অর্পিতাকে দেখলে আম্মু প্রশ্ন করবে না?
আব্বু: সেসব আমি সামলে নিবো।
আমি: হুম করো আমি যাচ্ছি।
তনিমা: ভাইয়া এই রাতের বেলা একা একা কোথায় যাবে?
আমি: ফ্রেন্ড এর বাসায়।
আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বেড়িয়ে পড়লাম।
হানিফের বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই আছমা এসে দরজা খুলে দিলো, আমাকে দেখে ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আছমা: ভাইয়া আপনি এত রাতে?
আমি: কেন আসতে পারিনা?
আছমা: কোনো প্রয়োজন ছাড়া তো আপনি ওর কাছে আসেন না তাই বললাম।
আমি: প্রয়োজনেই এসেছি, কয়েকদিন তোমাদের বাসায় থাকবো।
আছমা: সত্যি? আচ্ছা ভিতরে আসুন।
আমি: হানিফ কোথায়?
হানিফ: সূর্য আজ কোন দিকে উঠলো? সরি সূর্য তো উঠে আবার…
আমি: ফাজলামি রাখ।
হানিফ: আয়াস হঠাৎ আমার বাসায়? কিছু কি হয়েছে?
আমি: হুম অনেক কিছু।
হানিফ: সব শুনবো আগে খেতে বস, আছমা ওকে খেতে দাও।
আমি: খাবো না, ইচ্ছে নেই।
হানিফ: চল তো।
খেতে বসে খাবার নাড়াচাড়া করছি আর ভাবছি আজ যা হলো তা কি ঠিক হয়েছে? আমার বারবার কেন মনে হচ্ছে সবকিছু পরিস্থিতির কারণে হয়নি, এসবে হয়তো আব্বুর…
আছমা: ভাইয়া খাচ্ছেন না কেন?
আমি: ইচ্ছে করছে না।
হানিফ: কি হয়েছে বল তো।
আমি: অনেক কিছু হয়েছে, আব্বু এক হিন্দু মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।
হানিফ: কি? আয়াস তোর মাথা ঠিক আছে? কি বলছিস এসব?
আমি: যা বলেছি এটাই সত্যি।
হানিফ: কিন্তু কেন? হঠাৎ করে বিয়ে তাও আবার এক হিন্দু মেয়ের সাথে সবকিছু কেমন যেন লাগছে।
আমি: কি করবো বুঝতে পারছি না।
হানিফ: যা হবার তো হয়েই গেছে, এসব নিয়ে সকালে কথা বলবো। তুই যা একটু ঘুমিয়ে নে তোকে খুব টায়ার্ড লাগছে।
আমি: হুম।
বিছানায় শুতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো, ফোন হাতে নিয়ে আম্মুর কল দেখেই ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো, কি বলবো এখন আম্মুকে? কল কেটে গিয়ে আবার বেজে উঠলো, রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যাঁ আম্মু বলো।
আম্মু: তোর আব্বু বললো আজ নাকি তোরা আসবি না আর তুই নাকি ওখান থেকে কোন ফ্রেন্ড এর বাসায় চলে গিয়েছিস।
আমি: হ্যাঁ ওখানে ভালো লাগছিল না তাই হানিফের বাসায় চলে এসেছি।
আম্মু: কিছু কি লুকাচ্ছিস আমার থেকে?
আমি: না না কিকককি লুককাকাবো?
আম্মু: তোতলাচ্ছিস তারমানে কিছু হয়েছে।
আমি: কিছু হয়নি আম্মু, ঘুমাবো এখন রাখি।
আম্মু: তোর গলাটা কেমন ধরে আসছে, ঠিক আছে ঘুমো আর সকাল সকাল বাসায় ফিরে আসিস।
আমি: হুম আসবো।
ফোন রেখে চোখের পানি মুছে দুচোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইলাম।
সকালে আব্বুর ফোনে ঘুম ভাঙ্গলো, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করলাম।
আমি: বলো।
আব্বু: অর্পিতাকে নিয়ে বাসায় যেতে হবে, কোথায় তুমি?
আমি: তো যাও আমাকে কেন ফোন করেছ?
আব্বু: আশ্চর্য তো সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে তোমাদের, নতুন বৌ একা বাসায় যাবে নাকি? তুমি ওর সাথে যাবে না?
আমি: বিয়েটা তোমার ইচ্ছেতে হয়েছে তাই তুমিই ওকে নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ আমার বাসায় আমি কখন যাবো কার সাথে যাবো সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আব্বু: আয়াস?
আমি: চিৎকার করো না, গতকালের এই ঘটনার পর তোমার উপর থেকে আমার সম্মান কমে গেছে। তুমি এমন এক বাবা যে কিনা নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা না করে এক হিন্দু মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হবে বলে তার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছ। তোমার কাছে আমার কোনো মূল্য নেই, ওই তোমার ম্যানেজার সুমিত দত্ত আর উনার ভাগ্নির মূল্য আমার চেয়ে বেশি তোমার কাছে।
আব্বু: আমার আশেপাশে মানুষ নাহলে এখন তোমাকে…
আব্বু রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা কেটে দিলেন। বাসায় যেতে হবে, অর্পিতাকে দেখে আম্মু কি করবে আমিতো ভাবতেই পারছি না। আম্মুকে সামলানোর জন্য আমাকে বাসায় যেতে হবে তাড়াতাড়ি।
ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আসলাম, হানিফ আর আছমা বসে আছে।
হানিফ: উঠেছিস? ঘুমাচ্ছিলি তাই আর ডেকে বিরক্ত করিনি।
আমি: হুম নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আছমা: ভাইয়া নাশতা করবেন আসুন।
আমি: না, চলে যাচ্ছি আমি।
আছমা: কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন…
আমি: আম্মুকে সামলাতে হবে।
হানিফ: চল আমিও যাচ্ছি তোর সাথে।
আমি: হুম চল।
হানিফ গাড়ি চালাচ্ছে আর আমি দুচোখ বুজে গাড়িতে বসে আছি আর ভাবছি একটু পর কি হতে চলেছে। অর্পিতাকে দেখে বাসার সবার রিয়াক্ট কেমন হবে? সবাই কি অর্পিতাকে মেনে নিবে? দাদি.. দাদি কি পারবে হিন্দু এক মেয়েকে বাসায় জায়গা দিতে? উফফ ভাবতে পারছি না, মাথা ধরে যাচ্ছে এসব ভাবনায়, পাগল হয়ে যাবো আমি।
হানিফ: আয়াস? (দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে ছিলাম হঠাৎ হানিফের ডাকে চোখ খুলে তাকালাম, বাসায় চলে এসেছি)
হানিফ: চল।
আমি: হুম।
কলিংবেল চাপতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিলেন, আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন এসে।
আম্মু: কি হয়েছে আয়াস? তোর চোখমুখ এমন লাগছে কেন? তোর আব্বু আর তনিমা কোথায়?
আমি: একসাথে এত প্রশ্নের উত্তর দিবো কিভাবে আম্মু? (আম্মুকে সরিয়ে দিয়ে টেবিলের কাছে এসে চেয়ারটা টেনে বসলাম, আম্মু এসে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন আমার দিকে, ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে নিলাম কিন্তু তবুও যেন ভিতরটা শান্ত হচ্ছে না)
আম্মু: কি হয়েছে বাবা বল আমাকে।
হানিফ: আন্টি এসব প্রশ্ন ওকে পরেও করতে পারবেন আগে ওকে কিছু খেতে দিন, অনেক বেলা হয়েছে ও এখনো কিছু খায়নি।
আম্মু: কিরে তুই তো খিধা সহ্য করতে পারিস না, আজ কি এমন হলো যে এত বেলা অব্ধি না খেয়ে আছিস? (আম্মু কিচেনের দিকে চলে গেলেন, প্লেটে করে খাবার নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন)
আম্মু: আমি খাইয়ে দিচ্ছি খেয়ে নে ভালো লাগবে দেখিস। (আম্মু আমার দিকে এক লোকমা খাবার এগিয়ে দিতেই কলিংবেল বেজে উঠলো, খাবো কি ভয়ে তো আমার বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে)
আম্মু: তোর আব্বু আর তনিমা চলে এসেছে হয়তো।
আমি: আরো একজন সাথে এসেছে আম্মু, আমি দরজা খুলছি।
আম্মু আমার কথার মানে বুঝতে না পেরে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, আমি দরজার দিকে এগিয়ে আসলাম।
দরজা খুলে দিতেই আব্বুর পাশে অর্পিতাকে দেখতে পেলাম, অর্পিতা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অর্পিতার থেকে চোখ সরিয়ে দরজা থেকে সরে আসলাম। আম্মু দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েই অর্পিতার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
আম্মু: ও কে?
তনিমা: চাঁচি…
আব্বু: পরে বলছি আগে ওকে ভিতরে নিয়ে যাও।
আম্মু: হুম এসো। (তনিমা অর্পিতাকে নিয়ে ভিতরে আসলো, অর্পিতা ড্যাবড্যাব করে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে)
আম্মু: এবার বলো ও কে।
আব্বু: দেখো আফরোজা যা হবার তা কিন্তু হয়ে গেছে মানে পরিস্থিতিতে পড়ে সেটা আমাদের মেনে নিতে হয়েছে। এখন রাগ করে কোনো কিছু আর পাল্টানো যাবে না তাই বলছি তুমিও রাগ না করে সবকিছু মেনে নাও।
আম্মু: কি ঘটেছে আর কি মেনে নিবো? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আব্বু: ও আয়াস এর স্ত্রী, গতকাল ওদের বিয়ে হয়েছে। (আব্বুর মুখে আমার বিয়ের কথা শুনে আম্মু কেমন যেন পাথরের মূর্তির মতো হয়ে গেছেন)
তনিমা: চাঁচি এখানে বসো তুমি, কিচ্ছু হয়নি সব ঠিক হয়ে যাবে। (তনিমা আম্মুকে সোফায় বসিয়ে দিলো, আম্মু অর্পিতার দিকে তাকিয়ে আছেন)
আব্বু: আফরোজা সবটা কিন্তু পরিস্থিতিতে পড়ে হয়েছে কাজেই এখন আর রাগ…
আম্মু: একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?
আব্বু: তখন তোমাকে এসব বললে তুমি দুশ্চিন্তা করতে।
আম্মু: তাই বলে আমার ছেলের বিয়ের কথা আমাকে জানাবে না? (আম্মুর চিৎকারে অর্পিতা কেঁপে উঠে তনিমার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। আম্মুর চিৎকার শুনে সবাই ড্রয়িংরুমে চলে আসলো।
দাদি: কি হয়েছে ছোট বৌমা চেঁচাচ্ছে কেন? আর এই মেয়ে কে?
আব্বু: তোমার নাতবৌ। আরে আমিতো আয়াস এর ভালো চাই সবসময়, এই বিয়েটাও আয়াস এর ভালো বুঝেই দিয়েছি আমি। তোমরা কেন বুঝতে পারছ না?
দাদি: নাতবৌ? দেখি দেখি… (দাদি গিয়ে অর্পিতার গালে হাত বুলিয়ে দিলেন)
দাদি: লক্ষী একটা মেয়ে নিয়ে এসেছিস, বিয়েটা যেভাবেই হউক বিয়ে তো বিয়েই, এখন থেকে ও এই বাড়ির বউ।
ভাবি: আমার জা’কে আমাকে দেখাবে না? (ভাবি এসে অর্পিতাকে জড়িয়ে ধরলো। বাহ্ সবাই তো খুব পছন্দ করেছে ওকে, ওর আসল পরিচয় জানার পর ওকে মেনে নিলেই হলো)
দাদি: ছোট বৌমা সাদিকুর তো আর আয়াস এর খারাপ চাইবে না, যা হবার হয়েছে তুমি মেনে নাও।
আম্মু চুপচাপ বসে আছেন দেখে বুঝতে পারলাম আম্মু কিছুতেই অর্পিতাকে মেনে নিবেন না। আম্মু আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করতে পারেন ভেবে রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
থমকে দাঁড়ালাম যখন দেখলাম আম্মু অর্পিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আম্মু অর্পিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অর্পিতা আম্মুকে পা ধরে সালাম করলো যদিও ওদের জন্য এইটা প্রণাম। অর্পিতার এমন ব্যবহারে সবার মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। আম্মু অর্পিতার থুতুনি ধরলেন, ও আম্মুর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
আম্মু: নাম কি তোমার?
অর্পিতা: জ্বী অর্পিতা… অর্পিতা রায়। (রায় শব্দটা শুনে আম্মু কেঁপে উঠলেন, মুহূর্তের মধ্যে সবার হাসিমাখা মুখ মলিন হয়ে গেল)
আম্মু: অর্পিতা রায়? রায় তো হিন্দুদের…
অর্পিতা: আমি হিন্দু। (সবাই অবাক হয়ে অর্পিতার দিকে তাকিয়ে আছে। আম্মু রেগে গিয়ে আব্বুর পাঞ্জাবীর কলার চেপে ধরলেন)
আম্মু: শেষমেশ তুমি একটা হিন্দু মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিয়েছ? মেয়েটা লগ্নভ্রষ্টা হবে বলে তুমি আয়াস এর সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দিলে? একবারো ভাবনি আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎ কি হবে?
আমি: কিভাবে ভাববে আম্মু? উনার কাছে আমার কোনো মূল্য আছে নাকি? উনার কাছে তো উনার বিজনেস আর কর্মচারীরা ইম্পরট্যান্ট। শুধু তাই নয় কর্মচারীদের বাড়ির লোকও উনার কাছে ইম্পরট্যান্ট শুধু আমি উনার কাছে মূল্যহীন।
আব্বু: আয়াস এসব কি বলছিস?
আম্মু: আয়াস একদম ঠিক বলেছে।
আব্বু: কিন্তু বিয়েটা হয়ে গেছে।
আম্মু: কিসের বিয়ে? একজন হিন্দু মেয়ের সাথে একজন মুসলিম ছেলের বিয়ে কখনোই সম্ভব না।
আব্বু: বিয়েটা আমাদের ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে, রেজিস্ট্রিও হয়ে গেছে।
আম্মু: এই বিয়ের কোনো মানে হয় না, এই বিয়ে তখনি সম্ভব হতো যখন এই মেয়ে বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতো। এই মেয়ে হিন্দু থাকা অবস্থায় বিয়ে দিয়েছ কাজেই এই বিয়ে হয়নি। আর তাই এই বাসায় ওর কোনো জায়গা হবে না, ওকে ওর বাড়িতে ফেরত দিয়ে আসো। (আম্মুর কথা শুনে অর্পিতার দুচোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হলো, অর্পিতা কাঁদছে? কিন্তু কেন? অর্পিতা তো দুর্জয়কে ভালোবাসে তাহলে আমাদের বাসায় থাকার জন্য কাঁদছে কেন?)
আব্বু: এসব কি বলছ? ওকে ফেরত দিয়ে আসবো মানে? এ হয় নাকি? অর্পিতা এখন এ বাড়ির বউ।
আম্মু: এই বিয়েটাই তো হয়নি তাহলে এ বাড়ির বউ ও হবে কিভাবে? একটা হিন্দু মেয়ে আমার বাড়ির বউ কিছুতেই হতে পারে না।
আব্বু: আমি বলেছি ও এ বাসায় থাকবে, আর থাকবে বলেছি মানে থাকবে।
দাদি: তোরা ঝগড়া বন্ধ করবি? যা হবার তো হয়েই গেছে এখন ঝগড়া করে কি হবে? তারচেয়ে বরং এইটা ভাব কি করে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।
আব্বু: সমাধান একটাই মা অর্পিতা আয়াস এর স্ত্রীর অধিকার নিয়ে এই বাসায় থাকবে।
আম্মু: তাহলে আমি এই বাসায় থাকবো না। (আম্মুর কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল)
আম্মু: হয় এই মেয়ে বাসায় থাকবে নাহয় আমি।
আমি: আম্মু এসব তুমি কি বলছ?
অর্পিতা: এই বিয়েটা আমি মন থেকে করিনি আর এখানে আসতেও চাইনি। আমার মা খুব অসুস্থ, শুধু উনার জন্য আমি এখানে এসেছি। এখন আমি ফিরে গেলে আমার মা সেটা সহ্য করতে না পেরে মারা যাবেন।
তনিমা: হ্যাঁ চাঁচি উনার মা সত্যিই খুব অসুস্থ।
আব্বু: আফরোজা এখন তুমি সিদ্ধন্ত নাও কি করবে। মনে রেখো অর্পিতা ফিরে গেলে ওর মা মারা যাবে। তুমি যদি চাও একজন মা মারা যাক তাহলে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারো। আর হ্যাঁ এইটাও মনে রেখো অর্পিতার বাবা নেই, ওর মা মারা যাওয়া মানে ও একেবারে অনাথ হয়ে যাবে।
আব্বু কথা গুলো বলে চুপচাপ বসে রইলেন। আম্মু চুপচাপ বসে কি যেন ভাবছেন, হয়তো কি সিদ্ধান্ত নিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অর্পিতার দিকে তাকালাম নীরবে চোখের পানি ফেলছে। আমি আর কি করবো আম্মুর সিদ্ধান্ত জানার জন্য সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করছি।
কিছুক্ষণ পর আম্মু ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন, আম্মুর পাশে এসে বসলাম। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
আম্মু: আমার ছেলের জীবনটা তো অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলেই দিয়েছ এখন আর কি করার। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আব্বু: কি সিদ্ধান্ত?
আম্মু: আমি অর্পিতাকে ভাবার জন্য আজকের দিনটা সময় দিলাম, অর্পিতা ভেবে বলুক আমার কোন সিদ্ধান্ত ও মেনে নিবে।
আব্বু: কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ সেটা তো বলো।
আম্মু: অর্পিতা আশ্রিতা হিসেবে এই বাসায় থাকতে পারবে আর ওর মা সুস্থ হলে পর ফিরে যাবে। মনে রেখো আশ্রিতা হিসেবে আয়াস এর স্ত্রী হিসেবে নয়, ওকে আয়াস এর থেকে দূরে থাকতে হবে। অথবা অর্পিতাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। যদি অর্পিতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে আমি নিজে ওদের আবার বিয়ে দিবো।
আম্মু কথা গুলো বলে চলে গেলেন। আব্বু অর্পিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রুমের দিকে চলে গেলেন। অর্পিতা দফ করে সোফায় বসে পড়লো, খুব কাঁদছে ও। ভেজাভেজা চোখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। হয়তো আম্মুর কোন সিদ্ধান্ত মেনে নিবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না। আচ্ছা অর্পিতা কোন শর্ত মেনে নিবে? নিশ্চয় কিছুদিন পর ফিরে যাবে কারণ ও তো দুর্জয়কে ভালোবাসে…
চলবে?
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com