Breaking News

আমার গল্পে তুমি || পার্ট: ২৩ || লেখিকা: সুলতানা তমা

হিমি আর আমি দুজন দুজনের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। এখনো হিমির দিকে তাকিয়ে আছি দেখে হিমি মিষ্টি হেসে ফোনের দিকে ইশারা করলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আব্বু, এবার কি বলবো?
আমি: হ্যালো।
আব্বু: কোথায় তুমি?
আমি: কেন?
আব্বু: তুমি জানো তোমার বোনের বিয়েটা আটকে আছে শুধুমাত্র তোমার বোকামির জন্য?
আমি: আমি কি করলাম?
আব্বু: হিমি কোথায়? তুমি বাসায় নেই আর হিমিকে পাওয়া যাচ্ছে না, হিমির ভাইয়েরা ভাবছে তুমি হিমিকে কিডন্যাপ করেছ।
আমি: কিডন্যাপ?
আব্বু: হ্যাঁ, আর হিমির ভাইয়েরা বাসায় পুলিশ নিয়ে এসেছে। রুদ্র বলেছে তুমি হিমিকে ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত ফারিয়ার বিয়ে ওরা হতে দিবে না।
আমি: সত্যি?
আব্বু: তুমি খুশি হয়েছ? আমার তো ভয় হচ্ছে অসীম ফারিয়াকে বিয়ে করবে কিনা এইটা ভেবে আর তুমি হাসছ?
আমি: হিমির ভাইদের বলে দাও হিমি আমার কাছে আছে। আর হ্যাঁ সাথে এইটাও বলে দিও আমাদের সম্পর্ক মেনে নিলে তবেই আমি হিমিকে ফিরিয়ে দিবো। (ফোন কেটে দিলাম, খুব শান্তি লাগছে এইটা ভেবে যে আপুর বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে)
হিমি: কি হয়েছে এতো খুশি লাগছে কেন তোমাকে?
আমি: আমি তোমাকে কিডন্যাপ করেছি?
হিমি: মানে?
আমি: তোমার ভাই ভেবেছে আমি তোমাকে কিডন্যাপ করেছি আর তাই ওরা বাসায় পুলিশ এনেছে। আমি তোমাকে ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ওরা আপুর বিয়ে হতে দিবে না।
হিমি: কি বলছ এসব? আপুর বিয়েটা তো ভেঙ্গে যাবে।
আমি: হ্যাঁ আমিতো সেটাই চাই। আমরা অনেক দেরি করে বাসায় ফিরবো, তোমার ভাইয়ারা বিয়ে আটকে রাখবে ততোক্ষণ, আর অসীমের পরিবার ধৈর্য হারা হয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে।
হিমি: বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে?
আমি: হ্যাঁ। আপুর ভালোবাসার মানুষ কে সেটা জেনে তার সাথে আপুর বিয়ে দিবো।
হিমি: আপুকে খুব ভালোবাস তাই না?
আমি: হুম অনেক। এবার চলো এই জায়গা থেকে যাই।
হিমি: কিন্তু কোথায় যাবো?
আমি: রাত দশটা বাজে, বাসায় ফিরতে ফিরতে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।
হিমি: ঠিক আছে।

আমি বাইক চালাচ্ছি আর হিমি দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে পিছনে বসে আছে। বাসায় ফিরার পর কি হবে আমি জানিনা তবে এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে, ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তটাকে বেঁধে রাখি।
হিমি: আরশান? (হঠাৎ হিমির ডাকে আমার ঘোর কাটলো)
আমি: হুম বলো।
হিমি: কতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনছই না।
আমি: বাইক এর পিছনের সিটে যদি বউ এভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে তাহলে কি অন্য কিছু শুনতে মন চায়? আমার তো ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তটাকে বেঁধে রাখি।
হিমি: এসব সুখকর অনুভূতি চলে যাবে যখন বাসায় ফিরে দেখবে সবাই রেগে আছে।
আমি: থাকুক সবাই রেগে, আমিতো আমার মায়াবতীকে আমার বউ করে নিয়েছি আর কোনো ভয় নেই।
হিমি: তুমি তো আমার উপর রেগে ছিলে তাহলে বিয়েটা করলে কেন?
আমি: রাগ তো ক্ষণিকের জন্য, রাগের জন্য ভালোবাসা ভুলে যাবো? রাগ যতো গভীরই হউক না কেন ভালোবাসার গভীরতার কাছে রাগের গভীরতা কিছুই না। রাগ একদিন দুদিন থাকবে খুব বেশি হলে কয়েক বছর থাকবে কিন্তু একটা সময় রাগ কমে যাবে, তখন চাইলে কি আমি আর তোমাকে ফিরে পাবো? ক্ষণিকের রাগের জন্য ভালোবাসা হারানো বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। সম্পর্কে রাগ অভিমান খুনসুটি হবেই তাই বলে একেবারে ছেড়ে চলে যাবো?
হিমি কিছু না বলে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমায়, ওর পাগলামি দেখে মুচকি হাসলাম।

ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন থমথমে হয়ে থাকে তেমনি এখন আমাদের বাসাটা থমথমে হয়ে আছে। বাসায় ঢুকতে ভয় হচ্ছে, হিমির হাত শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে বাসায় ঢুকলাম। পুলিশ সহ বাসার সবাই ড্রয়িংরুমে বসা দেখে ভয়ে বুক ধড়পড় করছে আমার।
রোদেলা: ওই তো ভাইয়া আর হিমি। (রোদেলার কথা শুনে সবাই আমাদের দিকে তাকালো, হিমির আম্মু ছুটে আসলো হিমির দিকে)
আন্টি: কোথায় ছিলি? এই ছেলে তোর কোনো ক্ষতি করেনি তো?
রোদেলা: ক্ষতি কেন করবে ভাইয়া কি ওকে কিডন্যাপ করেছিল নাকি? ভাইয়া তো ওকে ভালোবাসে।
চাচ্চু: চুপ কর তুই। আরশান কোথায় ছিলি তুই?
আম্মু: ধমকাচ্ছ কেন? আমি জিজ্ঞেস করছি।
আব্বু: কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই, যে ছেলের জন্য আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে সে ছেলের জায়গা আমার বাসায় নেই, ওকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলো। (বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে আব্বুর দিকে তাকালাম আব্বু রেগে আগুন হয়ে আছেন, চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আপুকে খুঁজলাম কিন্তু আপু তো এখানে নেই)
আম্মু: আমার ছেলে কোথাও যাবে না। ছেলে পক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে সেটা কি আরশানের দোষ? বরং ভালো হয়েছে কারণ ফারিয়ার এই বিয়েতে মত ছিল না।
আব্বু: বিয়ে করতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে কে বিয়ে করতে চাইবে? পুলিশ নিয়ে কি ঝামেলা...
আন্টি: এই ছেলে তোকে কিডন্যাপ করেছিল তাই না?
বড় ভাইয়া: আরশান কি তোর কোনো ক্ষতি করেছে?
আম্মু: তখন থেকে কিসব উল্টাপাল্টা বলেই যাচ্ছেন আমার ছেলে হিমিকে কিডন্যাপ করতে যাবে কেন? ওরা তো দুজন দুজনকে ভালোবাসে।
বড় ভাইয়া: হিমি তুই কি ভয় পাচ্ছিস?
আব্বু: তোমাদের জন্য আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে আমার মান সম্মান সব শেষ হয়ে গেছে, এখন যদি তোমরা আরশানকে কিডন্যাপার প্রমাণ করতে না পারো তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। আমি তোমাদের সবাইকে...
আমি: আব্বু প্লিজ থামো, আমি হিমিকে কিডন্যাপ করতে যাবো কেন?
চাঁচি: কিন্তু ওরা তো বলছে তুই কিডন্যাপ করেছিস।
আদিত্য: ভাইয়া হিমিকে কিডন্যাপ করেনি, আমি জানি ওরা দুজন কোথায় ছিল। (হঠাৎ আদিত্যর এমন কথা শুনে হিমি আমি দুজনেই ভয়ে আতকে উঠলাম, কি জানে আদিত্য? বিয়ের কথা নয়তো? যদি সবাইকে বলে দেয়?)
পুলিশ: কি জানো বলো।
হিমি: আমি বলছি। আরশান আমাকে কিডন্যাপ করেনি, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমাদের দুজনের মধ্যে একটু মান অভিমান চলছিল তাই সবকিছু মিটিয়ে নেওয়ার জন্য দুজন ঘুরতে গিয়েছিলাম এছাড়া আর কিছুই না।
বড় ভাইয়া: হিমি?
হিমি: ধমক দিচ্ছ কেন ভাইয়া?
পুলিশ: সরি আমাদের কিছু করার নেই। (পুলিশ চলে গেলো, হিমির ভাইয়েরা রাগে গজগজ করতে করতে উপরে চলে গেল। হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ওকে ইশারা করে রুমে চলে যেতে বললাম, হিমি চলে গেলো)
আব্বু: শান্তি পেয়েছিস তো? বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে। ফারিয়ার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, লোকে হাজারটা কথা শুনাচ্ছে, আমার সব সম্মান শেষ হয়ে গেছে।
আব্বু কাঁদছেন দেখে আব্বুর দিকে এগিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু আম্মু মাথা নেড়ে না করলেন, চুপচাপ রুমের দিকে চলে আসলাম।

ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকতেই দেখি আপু খাবার নিয়ে বসে আছে, আমাকে দেখে আপু মুচকি হাসলো।
আপু: খেয়ে নে।
আমি: (নিশ্চুপ)
আপু: মন খারাপ? আচ্ছা হিমি আর তুই কোথায় ছিলি?
আমি: একটু বাইরে গিয়েছিলাম।
আপু: আর এর মধ্যে বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো।
আমি: খুশি হওনি?
আপু: বুঝতে পারছি না, বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে ভেবে খুশি লাগছে কিন্তু আব্বুর মন খারাপ আর লোকের হাজারটা কথা শুনে খারাপ লাগছে।
আমি: সবসময় লোকের কথায় কান দিলে চলে না, মাঝেমাঝে নিজের সুখের জন্য লোকের কথাকে তুচ্ছ করে দেখতে হয়। আর আব্বুর মন খারাপ বলছ? আব্বু যখন তোমার মুখে হাসি দেখবে তখন মন খারাপের মেঘটা সরে যাবে দেখো, বাবারা এমনই হয়।
আপু: খুব বড় হয়ে গেছিস। (আপুর কথা শুনে হিমি আর আমার বিয়ের কথা ভাবলাম, সত্যি বড় হয়ে গেছি তাইতো কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি)
আপু: কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি? খেয়ে নে আসছি আমি।
আমি: হুম।

বারান্দার রেলিং ধরে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছি আর ভাবছি যখন সবাই আমাদের বিয়ের কথা জানবে তখন কি হবে? মেনে নিবে তো সবাই? হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকালাম।
আমি: আদিত্য? ঘুমাসনি অনেক রাত হয়েছে তো।
আদিত্য: ঘুম আসছিল না তাই ছাদে বসে ছিলাম। তুমি কেন ঘুমাওনি?
আমি: এমনি।
আদিত্য: টেনশন হচ্ছে? শান্ত ভাইয়া আমাকে ফোন করে সব বলেছে। আর এইটাও বলেছে বাসায় কিছু হলে যেন ওদের জানাই আর সবসময় যেন তোমার পাশে থাকি। ভাইয়া ভাগ্য গুণে এমন বন্ধু গুলো পেয়েছ।
আমি: বিয়ের কথা বলেছে?
আদিত্য: হুম। টেনশন করো না আমরা সবাই আছি তোমাদের পাশে। ভাবি তোমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে যাও। (আদিত্যর কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, হিমি এতো রাতে ছাদে?)
আদিত্য: তাড়াতাড়ি যাও নাহলে মেয়েটা ভয় পাবে।
আমি: হুম।

দৌড়ে ছাদে আসলাম। হিমি দাঁড়িয়ে আছে, মৃদু বাতাসে হিমির খোলা চুল আর ওড়না উড়ছে। হিমির পাশে এসে দাঁড়ালাম।
হিমি: আরশান? (হিমি আমার দিকে না তাকিয়েই আমাকে ডাকলো)
আমি: কিছু বলবে? এতো রাত হয়েছে কিন্তু ঘুমাওনি যে?
হিমি: ভাইয়া বলেছে আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিবে পড়াশুনার জন্য। (হিমির কথা শুনে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো, ওর দিকে তাকিয়ে আছি শান্ত চোখে)
হিমি: খুব ভয় হচ্ছে।
আমি: আমার মনে হয় বিয়ের কথাটা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া উ...
হিমি: না। (হিমি চিৎকার করে উঠলো, বেশ অবাক হয়েই ওর দিকে তাকিয়ে আছি)
হিমি: বিয়ের কথা বলা যাবে না, ভাইয়ারা সহ্য করতে পারবে না।
আমি: তাহলে এখন কি করবো?
হিমি: আবারো একই কষ্ট পেলে আমার ভাইয়ারা মারা যাবে, সহ্য করতে পারবে না। (হিমি বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে বসে পড়লো, হিমির পাশে বসে ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। হিমি কাঁদছে, হিমির কথাগুলোর মানে কি? তবে কি ও কিছু লুকাচ্ছে আমার থেকে?)
হিমি: আরশান আমি তোমাকে ছেড়ে দূরে যেতে পারবো না, থাকতে পারবো না তোমাকে ছেড়ে।
আমি: দূরে যেতে হবে না, কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হয়ে যাবে দেখো।
হিমি: (নিশ্চুপ)

হিমি আমার কাধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে, এবার পাগলীটার কান্না থামানো প্রয়োজন নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আমি: হিমি আমাদের বিয়েটা কবে হয়েছে?
হিমি: কবে আবার আজ সন্ধ্যায়।
আমি: হুম। হিসেব মতে তো আজ আমাদের বাসররাত তাই না? (হিমি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো)
আমি: বাসর রাত, রাতের নিস্তব্ধতায় দুজন ছাদে বসে আছি, চাঁদের আলো, হীম শীতল বাতাস, সব মিলিয়ে রোমান্টিক একটা ওয়েদার। কোথায় একটু রোমান্স হবে তা না তুমি কেঁদে কেঁদে আমার শার্ট ভিজিয়ে যাচ্ছ।
হিমি: এই অবস্থায় তোমার রোমান্স করতে ইচ্ছে হচ্ছে? তোমাকে তো... (হিমি রাগি চোখে আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল ওর কোমড় জড়িয়ে ধরতেই শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, আলতো হাতে ওর দুচোখের পানি মুছে দিলাম)
আমি: বিয়ে নামক বন্ধনটার অনেক শক্তি, ভয় পেয়ো না আল্লাহ্‌ ছাড়া আমাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না।
হিমি: খুব ভালোবাস তাই না?
আমি: ভালোবাসি বলেই তো বিয়ে করেছি। আর কেঁদো না, আমার মায়াবতীর চোখে কান্না মানায় না, মায়াবতীর ঠোঁটের কোণে সবসময় হাসি মানায়।
হিমি: তাই?
হিমির কথার জবাব না দিয়ে আলতো করে ওর দুগালে ধরলাম, হিমি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে হিমির দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসলাম। হিমির ঠোঁটের কাছে আমার ঠোঁট নিতেই ও দুচোখ বন্ধ করে ফেললো। আলতো করে হিমির ঠোঁটে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম, হিমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো, ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো, পাগলী একটা।

আম্মু: আরশান কি হলো উঠ বলছি।
আমি: আম্মু কি হয়েছে এতো সকালে ডাকছ কেন?
আম্মু: আগে উঠ তারপর বলছি।
আমি: উঁহু।
আম্মু: আরশান হিমিকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। (আমি কি স্বপ্ন দেখছি? লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, আম্মু আমার পাশে বসা তারমানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখিনি)
আম্মু: তুই জানিস হিমি কোথায়?
আমি: সাতসকালে এসব কি বলছ?
আম্মু: সত্যি হিমিকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ওর ভাইরা তো ভাবছে তুই...
আমি: আম্মু তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে হিমি কোথায় যাবে? হিমির সাথে তো রাতেও আমার কথা হয়েছে আমরা দুজন একসাথে ছাদে ছিলাম।
আম্মু: বুঝতে পারছি না কিছু, হিমির আম্মু তো কাঁদতে কাঁদতে শেষ। (আম্মুর কথা শুনে বোবার মতো বসে রইলাম, কি বলছে আম্মু এসব? রাতে তো হিমি আমার কাছে ছিল, তখন লজ্জা পেয়ে দৌড়ে হিমি রুমের দিকে গিয়েছিল। এতো সকালে হিমি কোথায় যেতে পারে? আচ্ছা সজিব...)
বড় ভাইয়া: আরশান? (হঠাৎ ভাইয়ার ডাকে আমার ঘোর কাটলো, ভাইয়া এসে আমার পাশে বসলেন)
বড় ভাইয়া: হিমি কোথায় জানো? প্লিজ বলো। কথা দিচ্ছি আমি তোমাদের আলাদা করবো না।
আমি: (নিশ্চুপ)
বড় ভাইয়া: আরশান তুমি কাঁদছ? তারমানে কি...
আমি: হিমি কোথায় আমি জানিনা ভাইয়া। হিমির সাথে আমার রাতে লাস্ট কথা হয়েছিল। (ভাইয়া চুপচাপ চলে গেলেন। আম্মু এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন)
আম্মু: কাঁদছিস কেন? হিমিকে পাওয়া যাবে কান্না করিস না।
আমি: সজিব কিছু করেনি তো?
তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

কি করবো বুঝতে না পেরে শান্তকে ফোন দিলাম।
শান্ত: আরশান বল।
আমি: হিমি তোদের বাসায়?
শান্ত: নাতো, আসলে তো তারিনের সাথে দেখতাম। কি হয়েছে?
আমি: হিমিকে পাওয়া যাচ্ছে না। শান্ত আমার ভয় হচ্ছে সজিব কিছু করেনি তো? হিমির কিছু হলে আমি...
শান্ত: কিছু হবে না, হয়তো কোথাও গিয়েছে।
আমি: কি করবো এখন?
শান্ত: টেনশন করিস না তুই আমরা তোদের বাসায় আসছি।
আমি: ঠিক আছে।

হিমি কোথায় যেতে পারে? কোথাও গেলে তো আমাকে অন্তত জানিয়ে যেতো। নাকি আমার ভয়টাই সত্যি হবে? সজিব কি আবারো হিমিকে...
আব্বু: ভালো হচ্ছে না কিন্তু। (আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ আব্বুর কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম, আব্বু ড্রয়িংরুমে বসে ফোনে কথা বলছেন আর কাকে যেন ধমকাচ্ছেন)
আব্বু: কতবার বলবো তোমার বোনের ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা? আমার মেয়ে... (আব্বু থেমে গেলেন, ফোনের অপর পাশ থেকে কে কি বলছে শুনতে পাচ্ছি না তবে আব্বুর চোখেমুখে ভয়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি)
আব্বু: রুদ্র ফারিয়াকে ফিরিয়ে দাও বলছি, আমি তোমার বোনের খুঁজ জানিনা। কেন কিডন্যাপ করেছ আমার মেয়েকে আমি কিন্তু...
অপর পাশ থেকে ফোন কেটে দিলো, আব্বু চুপচাপ বসে আছেন, আব্বুর চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। আব্বুর কথা শুনে তো মনে হলো হিমির ছোট ভাইয়া আপুকে কিডন্যাপ করেছে। কিন্তু কেন? আচ্ছা এমন নয়তো আব্বু সজিবের সাথে হাত মিলিয়ে হিমির কোনো ক্ষতি করেছেন আর ছোট ভাইয়া সেটা বুঝতে পেরে আপুকে কিডন্যাপ করেছে? বুকটা কেঁপে উঠলো সজিব যদি হিমির কোনো ক্ষতি করে ফেলে এইটা ভেবে। হিমি আর আপুকে ফিরে পেতে হলে আব্বুর মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন, চুপচাপ আব্বুর দিকে এগিয়ে গেলাম...

চলবে😍

#আমার_গল্পে_তুমি

পার্ট: ২৪

লেখিকা: সুলতানা তমা

আমি আব্বুর সামনে এসে দাঁড়ালাম, আব্বু আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আব্বুর কপালে ছোট ছোট ঘামের ফোটা জম্মেছে, আব্বুর চোখ বলে দিচ্ছে উনি যে কোনো অপরাধ করেছেন।
আব্বু: কি?
আমি: আপু কোথায়?
আব্বু: হিমির ছোট ভাই ফারিয়াকে কিডন্যাপ করেছে।
আমি: কেন?
আব্বু: কেন আবার নিশ্চয় টাকা চাইবে।
আমি: তাই? আচ্ছা হিমি কোথায়? (আমার এই প্রশ্ন শুনে আব্বু বেশ ভয় পেয়ে গেলেন)
আব্বু: সেটা আমি কি করে জানবো?
আমি: আমার তো মনে হয় তুমি হিমির খুঁজ জানো আর রুদ্র ভাইয়া সেটা বুঝতে পেরে তোমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আপুকে কিডন্যাপ করেছে।
আব্বু: আরশান? এসব কি বলছিস তু...
আমি: চিৎকার করো না, ওদের বোন তাই ওরা কি করবে সেটা ওদের ব্যাপার কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো না। আমার বোন বা আমার ভালোবাসা কারো যদি কোনো ক্ষতি হয়েছে তাহলে কিন্তু ভুলে যাবো তুমি আমার বাবা।
আব্বু: আরশান তুই ভুল বুঝছিস আমি হিমির খুঁজ জানিনা। হিমিকে ওর ভাইয়ারা খুঁজে নিবে তার আগে তুই ফারিয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়, তুই বললে রুদ্র ফারিয়াকে ছেড়ে দিবে।
আমি: ফিরিয়ে তো আনবো দুজনকেই তবে যদি জানতে পারি এসবে তোমার হাত... (আমার ফোন বেজে উঠলো, অচেনা নাম্বার দেখে আব্বুর সামনে থেকে চলে আসলাম)

রুমে এসে ফোন রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যালো।
ভাইয়া: আমি বলছি।
আমি: রুদ্র ভাইয়া? আপু কোথায়?
ভাইয়া: তোমার আপুর কোনো ক্ষতি করবো না আমি, তোমার আব্বুকে বুঝানোর জন্য এই কাজ করেছি। হিমির খুঁজ তোমার আব্বু জানে যাও জিজ্ঞেস করো হিমি কোথায়।
আমি: কিন্তু ভাইয়া...
ভাইয়া: বললাম তো তোমার আপুর কোনো ক্ষতি করবো না।
ভাইয়া ফোন কেটে দিলো, ইচ্ছে হচ্ছে আব্বুকে শাস্তি দেই কিন্তু বাবা হন তো তাই পারবো না। আব্বু খুব ভালো করেই জানেন হিমি কোথায় তাইতো ভাইয়া আপুকে কিডন্যাপ করেছে। কিন্তু এখন আমি কি করবো? আব্বু অপরাধ করে থাকলেও তো স্বীকার করবেন না।

আদিত্য: ভাইয়া? (মাথায় হাত রেখে চুপচাপ বসে ছিলাম হঠাৎ আদিত্যর ডাকে সামনে তাকালাম)
আমি: কিছু বলবি?
আদিত্য: হুম কিছু বলার ছিল কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বলা উচিত হবে না। হিমি বা আপুর কোনো খুঁজ পেয়েছ?
আমি: আপু তো রুদ্র ভাইয়ার কাছে আছে কিন্তু হিমি কোথায় আছে কিছুই জানিনা, বড্ড ভয় হচ্ছে।
শান্ত: হয়তো সজিবের কাছে আছে হিমি। (হঠাৎ শান্তর মুখে এমন কথা শুনে দরজায় তাকালাম, সবাই এসে আমার পাশে বসলো)
সিফাত: এতো ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? হিমিকে আমরা ঠিক খুঁজে পাবো দেখিস।
আমি: হিমির ভাইয়েরা তো কম চেষ্টা করছে না কিন্তু এখনো তো কোনো খবর পায়নি।
শান্ত: আমার মনে হয় সজিব জানে হিমি কোথায়।
আমি: সাথে আব্বুও জানেন।
আরিয়ান: মানে?
আদিত্য: ভাইয়া এসব কি বলছ?
আমি: আব্বু নিজের স্বার্থে সব করতে পারেন।
আদিত্য: আমার মনে হয় একবার সজিবের বাসায় যাওয়া প্রয়োজন, হয়তো সজিবের কাছে হিমিকে পেয়ে যাবো।
আমি: এতো দূরে যাওয়ার কি প্রয়োজন? আব্বুকে বল সত্যিটা বলে দিতে তাহলেই তো আমি আমার হিমিকে পেয়ে যাবো।
শান্ত: আরে কাঁদছিস কেন?
আমি: কাঁদবো নাতো কি করবো? সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো, এতো সময় ধরে হিমি কোথায় আছে কেমন আছে আমি কিচ্ছু জানিনা। দুবছর আগের সেই চারদিন এর কথা হিমি আজো ভুলতে পারেনি, এখনো মেয়েটা ভয়ে আঁতকে উঠে ঐসব মনে পড়লে। আজ আবার নতুন করে...
আরিয়ান: কিচ্ছু হবে না ভয় পাস না, তোর আব্বুর কাছে যা।
আমি: কোনো লাভ হবে না।
শান্ত: তাহলে কি করবি?
সিফাত: সজিবের বাসায় যাবি?
আদিত্য: তাতেও লাভ হবে না কারণ সজিব তো আর অপরাধ করে বাসায় বসে থাকবে না।
আমি: আব্বু হিমিকে লুকিয়ে রেখেছে আমি নিশ্চিত, আব্বু নিজে থেকে না বললে আমাদের কিছু করার নেই। প্লিজ তোরা যা আমাকে একটু একা থাকতে দে।
সবাই চুপচাপ বেরিয়ে গেলো, আমি পাথরের মূর্তির মতো বসে আছি। বারবার একটা কথাই মনে আসছে হিমি কেমন আছে? কোথায় রেখেছে ওকে? আমার হিমি বোধহয় খুব ভয় পাচ্ছে।

ড্রয়িংরুমে পায়চারী করছি আর আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছি। সেই দুপুর থেকে আব্বু বাসায় নেই, সন্ধ্যা নেমে আসছে কিন্তু আব্বু আসার খুঁজ নেই। আব্বু ছাড়া হিমির খুঁজ কেউ দিতে পারবে না আমি নিশ্চিত। সজিবের বাসায় তো শান্তরা গিয়েছিল কিন্তু সজিব বাসায় নেই। আমার ভাবনা ভুল নাহলে সজিব আব্বুর কথায় হিমিকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। সারাটা দিন কেটে গেলো অথচ হিমির কোনো খুঁজ পেলাম না, ওদিকে আপু কেমন আছে কে জানে।
আম্মু: কিরে এভাবে অস্থির হয়ে আছিস কেন? (হঠাৎ আম্মু এসে সামনে দাঁড়ালেন। আচ্ছা আপুর জন্য কি আম্মুর টেনশন হচ্ছে না?)
আমি: আম্মু আপুকে তো পাওয়া যাচ্ছে না তোমার টেনশন হচ্ছে না?
আম্মু: ফারিয়া যেখানে আছে যার কাছে আছে খুব নিরাপদেই আছে।
আমি: মানে?
আম্মু: আমি ভাবছি হিমির কথা, জানিনা মেয়েটা কোথায় আছে।
রাইসা: আমি জানি। (হঠাৎ রাইসার কথা শুনে আম্মু আমি দুজনেই চমকে উঠলাম)
আমি: আবার এসেছ আমাকে জ্বালাতে? রাইসা আমার মন ভালো নে...
রাইসা: আমি তোমাকে জ্বালাতে আসিনি আরশান, আমি জানি হিমি কোথায়?
আম্মু: কিভাবে জানো? কোথায় হিমি?
আমি: বলো কোথায়?
রাইসা: কোথায় আছে সেটা বলতে পারবো না তবে কার কাছে আছে সেটা বলতে পারবো।
আমি: কার কাছে?
রাইসা: সজিব নামের কারো কাছে আর সেটা মামার কথায়।
আমি: আব্বুর?
রাইসা: হ্যাঁ, মামা সকালে সজিব নামের কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলেন হিমিকে কিডন্যাপ করার ব্যাপারে আর আমি সেটা শুনে ফেলেছি। আমি সাথে সাথে ফারিয়া আপুকে জানিয়েছিলাম কিন্তু তার কিছুক্ষণ পর থেকে আপুকেও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তোমাদের বাসায় যে কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আরশান আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি যে তুমি হিমিকে সত্যি ভালোবাস। হিমিকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তুমি সারাটাদিন ধরে যে ছটফট করছ তা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় তুমি হিমিকে আর হিমি তোমাকে দুজন দুজনকে সত্যি খুব ভালোবাস। আমি তোমাদের ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছি তাই আর তোমাদের মাঝে বাধা হয়ে থাকতে চাই না, যা হয়েছে তার জন্য সরি, পারলে আমাকে ক্ষমা করো আরশান।
আমি: তুমি যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ তাতেই আমি খুশি।
আম্মু: কিন্তু আরশান হিমি... (হঠাৎ আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো, রুদ্র ভাইয়ার নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলাম)
আমি: হ্যালো।
আপু: আরশান?
আমি: আপু কোথায় আছ তুমি? আর...
আপু: একটা ঠিকানা দিচ্ছি এই ঠিকানায় চলে আয়, শান্তদের নিয়ে আসিস।
আমি: আপু শুনো...
আপু তো ফোন কেটে দিলো। কিন্তু কিসের ঠিকানা বললো কার কাছে যেতে হবে আমাকে? ফোনের মেসেজটোন বেজে উঠলো, আপু একটা ঠিকানা মেসেজ করেছে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে শান্তকে একটা মেসেজ করে বেরিয়ে পড়লাম।

আপুর দেওয়া ঠিকানায় আসতে আমাদের অনেক রাত হয়ে গেলো, কলিংবেল চাপতেই একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। বোকার মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি, উনি মুচকি হেসে ভিতরে যেতে বললেন। ড্রয়িংরুমে এসে হিমি আর আপুকে দেখে চমকে উঠলাম, হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। দৌড়ে গিয়ে হিমিকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরে কেঁদে ফেললাম।
হিমি: আরশান কি করছ সবাই আছে এখানে।
আমি: তুমি তো ভালো আছ তাহলে আমাকে ফোন করনি কেন? জানো সারাটাদিন আমি কিভাবে কাটিয়েছি কত কষ্ট...
"এইযে হিমির বড় ভাই আছে এখানে" (কথাটা শুনে আচমকা হিমিকে ছেড়ে দিলাম, সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। কিন্তু এই লোক কে?)
আপু: আরশান শান্ত হ হিমি ভালো আছে। (আপুর কথা শুনে আপুর দিকে তাকালাম আপু বিয়ের সাজে সেজে আছে, হিমির দিকে তাকালাম হিমিও বউ সেজে আছে। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আপুর দিকে তাকালাম)
আপু: শান্ত হ সব বলছি।
হিমি: আরশান আমার আপু রিমি আর দুলাভাই। (অবাক হয়ে তাকালাম উনাদের দিকে)
আমি: আগে তো কখনো বলনি।
হিমি: পরে বলবো।
শান্ত: আপু তোমরা বিয়ের সাজে?
দুলাভাই: কারণ এখন এখানে দুটো বিয়ে হবে।
হিমি: আমি আরশানের সাথে আলাদা কথা বলে আসছি।
হিমি আমার হাত ধরে টেনে অন্য একটা রুমে নিয়ে আসলো।

হিমি: কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠতে পারছ না তাই তো? (হিমির কথার উত্তর না দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম)
হিমি: আরশান আমি জানি সারাদিন তোমার কতটা কষ্ট হয়েছে, এখন তো আমি তোমার কাছে আছি এখনো কান্না করবে?
আমি: (নিশ্চুপ)
হিমি: জানতে চাইবে না আমি কোথায় ছিলাম? আপুর কথা তোমাকে আগে কেন বলিনি? আর এখনই বা বউয়ের সাজে সেজে আছি কেন? (হিমিকে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম)
হিমি: পাঁচ বছর আগে আপু পালিয়ে এসেছিল দুলাভাই এর সাথে। ভাইয়াদের বললে হয়তো উনারা মেনে নিতো কিন্তু আপু বা দুলাভাই কেউ বলেনি। আর তাই আম্মু বলেছে আপু সবার কাছে মৃত। ভাইয়া বা আম্মুর সামনে আপুর কথা বলা বারণ ছিল। আপুর কথা মনে পড়লে কষ্ট হতো খুব তাই তোমাকে কখনো বলিনি আপুর কথা। আর এজন্যই বিয়ের কথাটা বলতে বারণ করেছিলাম কারণ আপুর মতো আমিও এমন করেছি শুনলে সবাই খুব কষ্ট পাবে।
আমি: কিন্তু তুমি এখানে কেন?
হিমি: তোমার আব্বুর জন্য।
আমি: মানে?
হিমি: আমিতো উনার মেয়ের মতো তবুও উনি আমার সাথে এতো খারাপ কিছু করতে পেরেছেন ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে। রাতে তোমার কাছ থেকে দৌড়ে আসার সময় উনি আমাকে দেখে ফেলেন আর ভোরবেলা উনার সাথে দেখা করার জন্য বলেন। আমার তো আব্বু নেই, তোমার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে মানে উনিই আমার আব্বু। আমি বিশ্বাস নিয়ে উনার সাথে ভোরবেলা দেখা করি বাগানে, তখনো সবাই ঘুমে। তোমার আব্বু প্রথমে বুঝান তোমার থেকে যেন দূরে চলে যাই তারপর খুব অপমান করেন। আমি বাধ্য হয়ে আমাদের বিয়ের কথাটা আব্বুকে বলে দেই কারণ আমি ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে গেছে শুনলে উনি আর রেগে থাকবেন না। কিন্তু উনি আমার ভাবনা গুলোকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আমি কিছু বুঝার আগেই সজিবের হাতে আমাকে তুলে দেন।
আমি: কি?
হিমি: হুম। সজিব আমাকে ওর চাচার বাসায় নিয়ে আসে তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন আমি আপুর কাছে শুয়ে ছিলাম।
রিমি আপু: আমাদের পাশের বাসাটাই সজিবের চাচার। সজিবের চাঁচি হিমিকে ছিনতেন আমার আর হিমির ছবি দেখেছিলেন, চাঁচি এসে আমাকে জানান তারপর আমরা পুলিশ নিয়ে গিয়ে হিমিকে নিয়ে আসি, সজিব এখন থানায় আছে। হিমি সেন্সলেস ছিল তাই মাথায় কাজ করছিল না, রুদ্রকে ফোন করে এখানে আসতে বলি, রুদ্র ফারিয়াকে নিয়ে আসে তারপর তোমাকে ফোন করে আসতে বলে। (রিমি আপুর মুখ থেকে কথাগুলো শুনে দফ করে বিছানায় বসে পড়লাম, আব্বু এসব করতে পারলো?)
রিমি আপু: আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার আর হিমির, রুদ্র আর ফারিয়ার বিয়ে আজই দিবো।
আমি: ছোট ভাইয়া আর আপুর?
হিমি: হ্যাঁ আরশান, তুমি বলেছিলে না আপু কাউকে ভালোবাসে? ছোট ভাইয়া আর আপু দুজন দুজনকে ভালোবাসে।
আমি: আর আমি একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি।
আপু: আমি বুঝতে দেইনি তাই তুই বুঝতে পারিসনি। (আপু এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পাশে বসলো)
আপু: হিমিরা যখন আমাদের বাসায় প্রথম আসে তখন আমি জানতাম না রুদ্র হিমির ভাই। আব্বু আমাকে জানান আর শর্ত দেন আমি যদি আব্বুর পছন্দে বিয়ে করি তাহলে আব্বু তোর আর হিমির সম্পর্ক মেনে নিবেন। তোর আর হিমির কথা ভেবে আমি রুদ্রকে সব বলি সাথে এইটাও বলি আমাকে যেন ভুলে যায় আর তারপরই আব্বুর পছন্দে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু শেষে আব্বু বেঈমানি করলেন। আজ যখন জানতে পারলাম আব্বু হিমিকে কিডন্যাপ করিয়েছেন তখন রুদ্রর সাথে আমি চলে আসি আর রুদ্র আব্বুকে ফোন করে বলে আমাকে কিডন্যাপ করেছে। আমরা ভেবেছিলাম আব্বু ভয় পেয়ে হিমিকে ফিরিয়ে দিবেন কিন্তু আব্বু কিছু করার আগেই দুলাভাই আর আপু হিমিকে পেয়ে যান।
দুলাভাই: বাকি কথা পরে হবে অনেক রাত হয়েছে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে হবে।
রিমি আপু: আরশান হিমিকে নিয়ে এসো, ফারিয়া চলো। (দুলাভাই এর ডাকে ওরা চলে যাচ্ছিল আমি আপুকে পিছু ডাকলাম)
আপু: কিছু বলবি?
আমি: বাসায় না জানিয়ে বিয়ে করবো? অন্তত আম্মুকে তো...
আপু: আম্মু সব জানেন আর আম্মুই অনুমতি দিয়েছেন আমরা যেন আজ রাতেই বিয়ে করি আর সকালে বাসায় ফিরে যাই। (আপু মুচকি হেসে চলে গেলো। কি করবো এবার? আবার বিয়ে করবো? কিন্তু এইটা কিভাবে সম্ভব?)
হিমি: আরশান সবাই যেহেতু মেনে নিয়েছে তাহলে নাহয় আবার আমাদের বিয়েটা হউক, তুমি প্লিজ কাউকে কিছু বলো না।
আমি: বিয়েটা কোনো খেলা নয় হিমি যে বারবার একই খেলা খেলবো, আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে তো তাহলে আমরা আবার কেন বিয়ে করতে যাবো?
হিমি: ভাইয়া শুনলে কষ্ট পাবে।
আমি: যা হবার হবে আমি দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে পারবো না। আমার কাছে বিয়ে শব্দটার অনেক মূল্য, বারবার বিয়ে বিয়ে খেলা করে বিয়ে নামক সম্পর্কটাকে অপমান করতে পারবো না।
হিমিকে রেখেই ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।

আপু আর রুদ্র ভাইয়া পাশাপাশি বসে আছে, অনেকদিন পর আবার আপুর মুখে হাসি দেখতে পাচ্ছি। সবাই বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত, কাজিও বসে আছেন।
আরিয়ান: কিরে আরশান হিমি কোথায়?
আমি: আসছে।
দুলাভাই: এখনো আসছে বললে তো হবে না অনেক রাত হয়েছে বিয়ের কাজ...
আমি: সবাইকে আমার একটা কথা বলার আছে।
রিমি আপু: হ্যাঁ বলো কি কথা।
আমি: বিয়েটা আমি করতে পারবো না। (আমার কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো, একজনের মুখের দিকে অন্যজন তাকাচ্ছে শুধু)
আপু: আরশান কি বলছিস এসব?
ছোট ভাইয়া: তুমি বোধহয় ভয় পাচ্ছ, দেখো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমার আব্বু বাদে বাকি সবাই আমাদের দুটো সম্পর্কই মেনে নিয়েছে এমনকি ভাইয়া আর আম্মুও।
আমি: ভাইয়া আমি ভয় পাচ্ছি না, আসলে হিমি আর আমার বিয়েটা হয়ে গেছে।
ছোট ভাইয়া: মানে?
শান্ত: হ্যাঁ ভাইয়া আমরা সবাই সাক্ষী থেকে ওদের বিয়ে দিয়েছি। গতকাল রাতে কাজি অফিসে বিয়েটা হয়েছে।
আপু: আরশান আগে কেন বলিসনি?
আমি: হিমি নিষেধ করেছিল। আপু যেখানে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে আবার কেন আমরা বিয়ে করবো?
রিমি আপু: কোনো প্রয়োজন নেই আবার বিয়ে করার আমরা সবাই মেনে নিয়েছি।
ছোট ভাইয়া: হিমি একবার আমাকে তো জানাতে পারতি। (ভাইয়ার কথা শুনে পিছনে তাকালাম, হিমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে)
হিমি: আসলে ভাইয়া আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কাজী: এবার কিন্তু সত্যি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
দুলাভাই: হ্যাঁ বিয়ের কাজ শুরু করুন ফারিয়া আর রুদ্রর। (হিমি এসে আমার পাশে দাঁড়ালো, এবার পাগলীর ভয় কেটেছে)
সিফাত: সবাই তো মেনে নিয়েছে বাসরের ব্যবস্থা করবো নাকি? (সিফাত ফিসফিসিয়ে কথাটা বললো, মুচকি হেসে হিমির দিকে তাকালাম, বউ সাজে মায়াবতীটাকে খুব সুন্দর লাগছে)

আপু আর রুদ্র ভাইয়ার বিয়ের ঝামেলা শেষে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি। হিমি আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে দেখে মৃদু হাসলাম।
রিমি আপু: আরশান রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো সারাদিন অনেক টেনশনে ছিলে।
আমি: ঠিক আছে আপু।

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি আর রাতের আকাশ দেখছি। হঠাৎ হিমি এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
হিমি: ভালোবাসি।
আমি: হঠাৎ এতো ভালোবাসা?
হিমি: আজ তোমার থেকে দূরে থেকে বুঝেছি কতটা ভালোবাসি তোমায়। (হিমিকে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: আমিতো ভেবেছিলাম তোমাকে বুঝি হারিয়ে ফেলবো।
হিমি: আমিও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর কখনো তোমার থেকে দূরে যাবো না।
হিমিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম, হিমির পেটে হাত রাখতেই হিমি কেঁপে উঠে আমার হাতের উপর ওর দুহাত রাখলো। হিমির চুলগুলো একপাশে নিয়ে ওর গলায় ঠোঁট ছুঁয়ালাম, হিমি কেঁপে উঠে ঘুরে গিয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে দিলো। মুচকি হেসে হিমির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললাম "ভালোবাসি"

চলবে😍

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com