গল্প- অসমাপ্ত ভালোবাসা || নীল আহমেদ
-হুম।(মায়া)
-বল কি বলবে?
-আমি সত্যিই দুঃখিত।
-কেন?
-আমার জন্য তোমায় এত অপমানিত হতে হল।
-আরে নাহ ঠিক আছে।তাছাড়া এ সবে আমি অভ্যস্ত।
-মানে?
-গরীব হলে এত সহজে অপমানবোধ করলে বেঁচে থাকা যায় না।
-কেন?
-আমাদের মান অভিমান আমাদের ভিতর সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।অন্যের উপর কখনই চাপানো যায়না।
-তুমি এত কিছু সহ্য কর কিভাবে?
-যেভাবে গরীব হয়ে জন্মে পাপ করেছি।
-তুমি মোটেও পাপ করনি।গরীবরাও মানুষ।
-পুরো পৃথিবী যেখানে আমাকে ধিক্কার দেয়,সেখানে তুমি বন্ধুত্বের কারনে কখনই আমাকে তোমাদের সমান করতে পার না।
-বিশ্বাস কর আমি যদি জানতাম কখনই তোমাকে এখানে নিয়ে আসতাম না।
-আরে পাগলী মেয়ে তুমি শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ।আমি কিছু মনে করিনি।
-ওরা কেন যে এমন করল।আমি সত্যিই লজ্জিত।(কেঁদে ফেলল)
-এই বোকা মেয়ে কাঁদছ কেন শুনি।আমি সত্যিই কিছু মনে করিনি।
-তাহলে না খেয়ে চলে যাচ্ছ কেন?
-শরীরটা দুর্বল লাগছে,তাই খেতে ইচ্ছে করছেনা।
– মিথ্যে কথা,তুমি অপমানে অবহেলায় চলে এসেছ।
-উহু সত্যিই অসুস্থ।
-কেন বার বার মিথ্যে বলছ।আর কাকেই বা বলছ যে গত ছয় মাস ধরে তোমাকে চিনে তাকে?
-বিশ্বাস কর মায়া আমি সত্যিই অসুস্থ।
-আবার মিথ্যে।
-এই মেয়ে যাওনা ওদিকে তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
-নাহ যাব না কিছু লাগবেনা আমার।
-পাগলামী কর না।
-আমি মোটেও পাগলামী করছি না ।তুমি না খেয়ে যেতে পারবে না।
-স্যরি মায়া আমি আর দাড়াতে পারছিনা পারলে ক্ষমা কর।(বলেই হাঁটা দিলাম)
-এই শুভ্র শোন…..(মায়া)
-দাড়িয়ে গেলাম।
-এদিকে তাকাও।
-কেন?
-হা কর?
-কেন বলবে তো…
-আমি বলছি হা করতে করবে এত কেন কেন কর কিজন্য।
-কিন্তু বলবে তো কি হয়েছে….
-এই নাও….(বলেই হাত থেকে একটা কেকের টুকরো মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিল)
-কথা বলতে পারছিনা শুধু দুচোখ বেয়ে পানি নেমেছে।
-আর বাধা দিব না এবার যেতে পার।(বলেই কান্না চোখে মায়া ভিতরের দিকে রওনা দিল)
-আমি কিছুক্ষন নীরব চোখে চেয়ে থেকে রওনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে….সত্যিই মেয়েটা একটা পাগলী।
.
আমি শুভ্র আর ও হল মায়া।আমরা বন্ধু একই ইয়ারে পড়ি।বন্ধু হলেও আমাদের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ আছে।হ্যা আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।বাবার কষ্টের উপার্জনের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করি,নিজেও ছোট খাট টিউশনি করি তবুও মাস শেষের আগে শূন্য হয়ে পড়ি।মিতব্যায়ী হয়ে চলার পরেও এমন ধনীর দুলালির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে ভাবতেই কেমন নাটকীয়তার মত লাগে তাইনা।কিন্তু এটা সত্যি এই মায়া মেয়েটা লাখে একটি।মেয়েটার চালচলন কথাবার্তা একেবারে সাধাসিধে,কোন অহঙ্কার নেই।প্রকৃত মানুষ যারা তারা হাজার গুন ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া সত্বেও নিজেদের সাধারন মানুষের মত ভাবে।মায়া মেয়েটিও তাদের ভিতর একজন।আমাদের বন্ধুত্বটা একটা মেঘলা দিনে।ছাতা ছিলনা সেদিন,খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ভিজতে ভিজতে বেরিয়েছি ক্যাম্পাস থেকে।যদিও সবারই বৃষ্টি প্রিয়,আমারও ভীষন প্রিয় তবু গরীবদের কাছে প্রিয় অপ্রিয় বলে কিছুই নেই।সবকিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়।প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে যখন ভিজে চলেছি তখন হঠাৎ করে মাথার উপর একটা আবরন সৃষ্টি হল।এইযে মিষ্টার এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে রাতেই জ্বর এসে যাবে।ছাতা আনেন নাই কেন?আমি কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেলাম,কারন একদিনে ক্লাসে এসে জানতে পেরেছি মায়া রীতিমত ধনি ঘরের মেয়ে।আর সে কিনা সামান্য একজন গরীবের মাথায় ছাতা ধরেছে ভাবতেই কেমন লাগে।যাই হোক সেদিনের পর থেকে আমার অনিচ্ছা থাকা সত্বেও বন্ধুত্ব করতে হল।সেখান থেকেই একটা গাঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।নাহ প্রেমের দিকে গড়ায়নি জাষ্ট ভাল বন্ধু।কারন একজন ব্যাক্তি সজ্ঞানে কখনই এই ভুলটি করবে না।
.
আজ মায়ার জন্মদিন ছিল।গতদিন ক্যাম্পাসে দাওয়াত করলে আমি ভীষন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।আমার মত একজন কিনা যাবে ওদের বার্থ ডে পার্টিতে।আমি প্রথমবারেই না বলেছি।কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা আমাকে যেতেই হবে।না গেলে বন্ধুর মত পরিচয় দিলাম কোথায়।অনেক ভেবে চিন্তে রাজি হলাম।কিন্তু আমার তো ব্রান্ডের শার্ট,জিনস প্যান্ট,জুতা নাই সেখানে উপস্থিত থাকার কোন যোগ্যতাই নেই।আমি অবশ্য আশা করেছিলাম এমনটাই হবে।মাত্র একতোড়া ফুল নিয়ে ওর বাসায় ঢুকে ওকে উইশ করে বসেছি।মায়া বলল তুমি বস আমি আসতেছি এক্ষুনি।সবাই কেমন হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে এসেছি বলে হয়ত বিনা পয়সায় জোকার দেখার সুযোগ পেল এরা।
বসে আছি দুজন ব্যাক্তির আগমন….
-হাই(ছেলেটি)
-হ্যালো।(আমি)
-আমি মায়ার কাজিন রাফি ও তমা।
-আমি মায়ার বন্ধু।
-আজিব মায়ার এমন একটা ভদ্র ফ্রেন্ড আছে জানতাম না তো।(মেয়েটি)
-আরে বলিস না এদের তো একটাই ধান্দা বাপ হল গরীব,বড়লোকের মেয়ে পটিয়ে লেখাপড়া করার খরচ চালাবে বলে নাটক করে।
-ছি ছি ছি ভাইয়া এসব কি বলছেন?(আমি)
-কেন তুমি কি কচি খোকা যে বুঝতে পারছ না।(ছেলেটি)
-দেখুন আমি তেমন নই।(আমি)
-সে তো পোষাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে থার্ড ক্লাস একটা।(মেয়েটি)
-কিছু বলতে গিয়েও ফিরে এলাম।কারন ভদ্রলোকের বাড়িতে এমনিই আমি অভদ্র ঢুকে পড়েছি।তাই আরও অপমান নিয়ে বাসার পথ ধরলাম।আফসোস থেকে গেলে মায়ার বাবা হয়ত ফোর্থ ক্লাসই বলত শোনা হলনা।আসলে অপমানবোধটা আমার এমনিতেই কম।কেন জানি হাজার অপামানেও আমার কোন কষ্ট হয়না চোখে পানি আসেনা।কিন্তু বোকা মেয়েটি আর ছাড়ল কই সেই তো জন্মদিনের কেকটা আমায় খাইয়ে দিয়ে স্যরি বলে গেল।আর কি মনে কোন দুঃখ থাকতে পারে।।।
.
পরেরদিন…..
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে সেই সকাল থেকে।সকালে মায়া ফোন দিয়ে বলল অমুখ জায়গায় আসতে।সত্যি বলতে ভিজে ভিজে এসেছি।ওইতো মেয়েটি ছাতা হাতে দাড়িয়ে আছে….
-কি ব্যাপার এই বৃষ্টির মাঝে এখানে ডাকলে কেন?(আমি)
-তোমাকে কিছু বলার আছে।(মায়া ছাতাটা আমার মাথার উপর ধরল)
-বলার আছে কাল বলতে না হলে ফোনে এখানে আসার কি দরকার?
-সবকিছু সবখানে বলা যায়না শুভ্র।
-মানে?
-শুভ্র জানো কাল সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি।
-কেন?
-তোমাকে ডেকে নিয়ে অমন ভাবে অপমান করা ঠিক হয়নি।
-আরে পাগলী ইটস ওকে।আমি বলেছিতো ওটা কিছুনা ভুলে যাও।
-কি করে ভুলব?
-মানে?
-আই লাভ ইয়ু শুভ্র।
-কিছুটা চমকে উঠে দূরে সরে গেলাম,মেয়েটি সেই ভুলটাই করল।
-কি হল দেবেনা একটু ভালবাসা আমাকে ভিক্ষা।
-মায়া প্লিজ থাম।
-কেন?আমি কি তোমার যোগ্য নই?
-মায়া বোঝার চেষ্টা কর আমাদের ভালসতে নেই কাউকে।মিথ্যে মায়াজাল সৃষ্টি করে কোন কোন লাভ নেই।
-আমার ভালবাসা মিথ্যে নয় শুভ্র।বিশ্বাস কর আমি সত্যিই তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।
-কেন করলে এই ভুলটা।
-জানিনা।
-ভুল সংশোধন করে নাও।
-পারব না।
-পারতে হবে কারন তুমি জানো আমাদের ভিতর কতটা ব্যবধান।
-ভালবাসায় কোন ব্যাবধান থাকেনা।
-হুম কিন্তু সংসারে তার প্রয়োজন আছে।
-আমার কিছুই চাই না।
-কিন্তু আমার তো চাই?
-কি চাও?
-তোমাকে সুখে রাখতে সবকিছু যা কখনই সম্ভব নয়।তাই ফিরে যাও।
-আমি পারব না।
-প্লিজ মায়া অবুঝের মত কথা বল না।
-আমি সত্যিই ভালবাসি তোমাকে।
-আমি জানি তোমার চোখ সে কথা বলছে কিন্তু আমি নিরুপায়।
-প্লিজ।(বলেই হাত ধরল)
-হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পিছু ফিরলাম….
-শুভ্র এই শুভ্র শোন….(কেঁদে বেঁদে বলছে)
আই লাভ ইয়ু শুভ্র….
আস্তে আস্তে শবদটা মিলিয়ে যাচ্ছে।আমি পিছু তাকায়নি।কারন মায়ার মায়ায় আমি পড়তে চাইনা।জানি ওর ভালবাসা সত্যি সত্যি ছিল তবু আমি নিরুপায়,বাস্তবতা অনেক কঠিন যার কাছে আবেগের মূল্য নেই।হয়ত ও আমার কাছে সুখী থাকার জন্য কিছুই চাইত না,কিন্তু আমারও তো একটা মন আছে, আমারও তো প্রিয়জনকে কিছু সুখের মুহুর্ত দিতে ইচ্ছে হয় সেটাই যখন পারবনা তখন কেন ওর মনটা ভেঙে দিব।
আমি হিমু নই।আমি পিছু ফিরিনি কারন সত্যিকারের ভালবাসার কাছে আমি পরাজিত হয়ে জড়িয়ে পড়তাম।দুটি জীবন ভুল পথে পা বাড়াত।আজকের এই মায়ামুখটা যখন কষ্টে লাল হয়ে উঠবে আমি সহ্য করতে পারবনা।আমি সত্যিই তোমাকে ভালবাসি মায়া।কিন্তু বলা হলনা কখনও।ভুল বুঝে নিজেকে দূরে সরিয়ে নাও আমি তোমার সুখে হাসতে চাই….।।।।
(সমাপ্ত)
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com