Breaking News

লীনা আপু প্রেগন্যান্ট।

লীনা আপু  প্রেগন্যান্ট। 
ওর সর্বনাশ করেছে টুপি পরা এক মাওলানা।

 "বিয়ের আগেই বাচ্চা-" কথাটা অতিদ্রুত সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। লজ্জায় মুখ দেখাতে না পেরে লীনা আপুকে নিয়ে আতা ভাই রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল।
এইটা হল বাইরের খবর।
ভেতরের খবরটা একটু অন্যরকম। 

আমরা তখন স্কুলে পড়ি। 
ক্লাস এইট।
লীনা আপু তখন ক্লাস টেনে। ওর  বাবা তখন একজন সামান্য চাষী। 
অন্যদিকে টুপি পরা মাওলানার নাম আতাউল্লাহ। 
ওর বাবার নাম গণি উল্লাহ। 
হাতিমপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গণি উল্লাহ বিশিষ্ট ভদ্রলোক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। 

পিতার মৃত্যুর পর সংসারের দায় কাঁধে নিয়ে আতাহার ভাই গ্রামে এসেছিলেন। কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য গ্রামে আসার বছর দুয়েকের মধ্যেই ভিলেজ পলিটিক্স নামক এক দুষিত পাক-চক্রের সুতায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন।

গণি উল্লাহর পুত্র হিসেবে মাওলানা আতাউল্লাহ ছিল মূর্তিমান এক রাজপুত্র। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। যেকোনো প্রয়োজনে কোন মানুষ সাহায্য চাইলে, সে ফিরিয়ে দিত না। 

এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। 
কিন্তু সে নিজের হাতে শত্রু তৈরি করে ফেলছিল, কথায় কথায় সে মাদকের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে গিয়ে। 

 গণি উল্লার মৃত্যুর পরপরই খালেদ গ্রুপের দাপট খুব বেড়ে গিয়েছিল।  টাকাপয়সা ছড়িয়ে খালেদ তখন এলাকার চেয়ারম্যান। 
খালেদের পুত্র নসু হচ্ছে এখানকার নাম্বার ওয়ান গাঞ্জা ও ইয়াবার ডিলার। সুদখোর মহাজন। 
ওদের নানাবিধ অনাচার এবং অপকর্ম থেকে মুক্তির আশায় এলাকার কিছু মানুষ চাইছিল আতাউল্লাহ নির্বাচনে আসুক।
খালেদ এবং নসুর মুখে লবণ পড়ুব।

আতা ভাই এলাকার বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবেই হয়ত খুব আস্তেধীরে নিজেকে পিতার মতো যোগ্য করে গড়ে তুলবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভালো মানুষের কব্জির চাইতেও শয়তানের নখ বড় হয়।

 আতাউল্লাহ যেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে তার আগেই ওর পিঠে পেছন থেকে ছুরা বসিয়ে দেওয়া হল। 
হেমন্তের এক সুন্দর সকালে আচমকা শুনতে পেলাম,  নীলা আপু প্রেগন্যান্ট।  ওর সর্বনাশ করেছে টুপি পরা এক মাওলানা। 

 মিথ্যে এই অপবাদের গুজবে সারা গ্রাম চাউর হয়ে গেল। নীলা আপুকে সঙ্গে নিয়ে আতা ভাই রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল। 

এদিকে নানুর মৃত্যুর পর মামা সব ঢাকায় চলে গেল,  আমি নিজেও তখন হাতিমপুর ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। এরপর সুদীর্ঘ কাল গ্রামে আসি না, মাঝেমধ্যে গ্রামে আসলেও হাতিমপুরে যাওয়া হয়ে উঠে না। 

 এইবার গ্রামে এসে সপ্তাহখানেক থাকার পরেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। বাইরে বেরুনো নিষেধ তাও একদিন সন্ধ্যার দিকে নদীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে বলরামপুরের ঘাটে চলে গেলাম। সেখান থেকে ট্রলারে চড়ে নদী পথে হাতিমপুর। 

বহুকাল পর হাতিমপুরে যাওয়া। স্কুলের বন্ধুদের অনেকেই ওদিকে ছিল। মাঝেমধ্যেই ইনবক্সে কথা হতো। হাতিমপুর বাজারে নেমেই ওদের একজনকে ফোন দিলাম। ওরা দলমাদল ছুটে আসল। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর হাতিমপুর মাদ্রাসায় গিয়ে উঠলাম। মাদ্রাসার দপ্তরি মুমিন ভাই, গণিতের শিক্ষক তাইজুল হুজুর প্রমুখের সাথে দেখা হল। মাদ্রাসায় পেছনদিকে বন-জঙ্গলায় ভরা একটা পরিত্যক্ত সিঁড়িঘাটে বসে পুরনো সব দিবারাত্রির স্মৃতিচারণ করছিলাম। হঠাৎ করেই আমি আতা ভাইয়ের কথা জানতে চাইলাম। 
 "আতা ভাই এখন কোথায় আছেন? কেমন আছেন?"

 "সে এখন লন্ডন। বাংলা খানার রেস্টুরেন্ট দিছে। সুখে আছে আলহামদুলিল্লাহ!"

"গ্রামে আসে না?"

"না। লন্ডনে জায়গাজমি কিনেছে। রাজার হালে জীবনযাপন করছে। বেহুদা গ্রামে এসে করবে কী?"

 "তাও ঠিক।" আমার মাথায় পুরনো দিনের কথা ঘুরছিল। জানতে চাইলাম, "এখানকার চেয়ারম্যান এখন কে?"

"নসু মিয়া।"

"খালেদ চেয়ারম্যানের পুত্র?"

"হা।"

নসুর কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই ছেলে এককালে এখানে গাঞ্জা ও ইয়াবার সাপ্লায়ার ছিল। এখন সে চেয়ারম্যান। মনে মনে হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম তবুও কৌতুহলী কণ্ঠে জানতে চাইলাম, "সে এখন কেমন? এলাকার উন্নয়ন কাজ করে কিছু?"

 উন্নয়নের কথা শুনে ওরা বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। বন্ধু সুমন বলে, "সে একটা প্রথম শ্রেণির বাঞ্চোদ।"

মনে মনে যা সন্দেহ করেছিলাম তাই তাহলে সত্য হয়েছে। জানতে চাইলাম, "গ্রামের মধ্যে এত এত ভালো মানুষ থাকতে নসু কীভাবে চেয়ারম্যান হয়?"

ওরা কেউ জবাব দিল না। 
 আতা ভাইয়ের মতো মানুষকে লুচ্চা বলে বিতাড়িত করা হয়েছে। নসুরা রয়ে গিয়েছে নিয়তির মতো। নিয়তির বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা ওদের নেই। 

 রাতে থাকার জায়গা হল সুমনের বাসায়। খানাপিনার পর পেছনের দিকের বাগানের বসে সিগারেট পুড়াচ্ছি আর টুকিটাকি কথা বলছি। সুমন সিগারেট টানে না। মোবাইলে ঘাটাঘাটি করছিল। সে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "আতা ভাই একটা ভিডিও ছাড়ছে গতকাল, দেখ.."

"কিসের ভিডিও? আতা ভাই?"

 "হু।"

দীর্ঘ কাল পর আতা ভাইয়ের মুখ দেখলাম। ওর বয়স এখন প্রায় চল্লিশ। ফর্সা মুখ, সুন্দর চোখ। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি। লন্ডনে নিজের বাসায় বসে একটা ভিডিও করেছেন। ভিডিওর টপিক করোনা বিভীষিকায় কম্পমান পাশ্চাত্য সভ্যতা বনাম উল্লুক বাঙালি। 

 আতা ভাই এখনো কথা বলেন কিছুটা সিলেটি  একসেন্টে। এক কেজি চাউল কিংবা তিন টাকার একটা মাস্ক দিতে গিয়ে এদেশের কতিপয় নষ্টগামী দেশপ্রেমী ত্রাণ বিতরণের নাটক করছে। দল বেঁধে ছবি উঠাচ্ছে। ওদের এই ভণ্ডামিতে বিরক্ত আতা ভাই বিক্ষুব্ধ কন্ঠে বলছেন,

 "ওরে চণ্ডালের বাচ্চারা, তরার জ্ঞান এত নিচে ক্যানে? করোনার মত সেনসেটিভ  একটা জিনিস লইয়া এমন স্টুপিডিটি না করলেও চলত না?   ... বান্দর আর হনুমান যে জঙ্গলে থাকে, সেইগুলাও তোদের চেয়ে সভ্য..."

  আতা ভাইয়ের কথা শুনে হেসে ফেললাম আমি। কথা তিনি মিথ্যে বলেন নাই। কিন্তু উলু বনে মুক্তা ছড়াচ্ছেন। 

এক সময় আমি নিজেও এইসব স্টুপিডদের কর্মকাণ্ড দেখে তীব্র হতাশ বোধ করতাম। জ্বালা ধরত মনে। পরে দেখেছি, এরা সবাই উল্লুকের মতো কাজ করলেও দেশের মানুষ ঘুরেফিরে এদের দিকেই ছুটে যায়। নির্বাচনের আগের মৌসুমে একটা লুঙ্গি, শাড়ি কিংবা এক বালতি চাউলের বিনিময়ে পুরনো বিচ্ছেদ ভুলে গিয়ে এইসব উল্লুকদেরকেই নির্বাচিত করে।
 
দারিদ্র্য গুণনাশিনী!!!

 বাংলাদেশের টুপি পরা কিছু গণ্ডমূর্খর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন আতা ভাই। এইটা আমার ভালো লেগেছে। 

 "এখন আমি আমরার দেশের কাঠমোল্লা আর অন্ধমোল্লাদের কাছে একটা প্রশ্ন করি... 
কভিড-১৯ ভাইরাস যদি আনবিক লেবেলের ক্ষুদ্র না হয়ে গরু-মহিষের মত বড় হইত, আফনেরা তারে গজব বলতেন নি?  গজব কিংবা কু-বাতাস বলে উড়ায়ে দিতেন নি? - না দিতেন না!

 ভাইরাস জিনিসটা এতই ক্ষুদ্র যে, খালি চোখে দেখা যায় না, হেঁটে গেলে কানে আওয়াজ আসে না... 

 বাংলাদেশের অধিকাংশ মোল্লা-মুন্সির  চোখ আর কান এতই ভোতা যে, সাধারণ মানুষ যেটুকু দেখে, যেটুকু বুঝে - এরা তাও বুঝে না। 
সারা পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞান এক করে সারা বিশ্বের মানুষ যখন করোনার বিরুদ্ধে ফাইট করছে এরা তখনও এর অস্তিত্ব সম্পর্কেও অজ্ঞানতামূলক বাণী দিচ্ছে। মক্কা-মদীনা লকডাউনে, তাতে এদের কিছু আসে যায় না। এরা এখনো হল্লা দিয়ে মানুষ ডাকছে। মসজিদেই আসতে হবে। না আসলে তুই বেদ্বীন...

 কোথাও আগুন লাগলে সবাই আমরা ছুটে গিয়ে জল নিয়া আসি। চিল্লায়ে সবারে সাবধান হইতে বলি। আগুন থেকে দূরে থাকতে বলি।  আগুন দেখা যায়, ভাইরাস আগুনের চেয়েও খারাপ। শুধু চোখে দেখতে পাচ্ছেন না বলে সাবধান হবার বদলে ভুংভাং গল্প দিচ্ছেন..."

 করোনার ভাইরাস আনবিক লেবেলের ক্ষুদ্র না হয়ে সাপের মত দৃশ্যমান ও হিংস্র কোন প্রাণী হইলে সম্পূর্ণ নাটকটা কেমন হইত সেই দৃশ্য কল্পনা করে চমকিত হলাম। তবে আমি অবাক হয়েছি উনার শেষ কয়েকটা কথা শুনে। আতা ভাই বলছেন,

  "আজ থেকে একশ বছর পর পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে। সেই ইতিহাসে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে একটা অধ্যায় থাকবে। সেখানে লিখা হবে বোঁচা নাকের চীন যখন অদৃশ্য জীবাণু অস্ত্র ছড়িয়ে সমগ্র পৃথিবী লকডাউন করে অর্থনৈতিক আধিপত্যে প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাচ্ছিল, লাখে লাখে মানুষ মারা যাচ্ছিল,  বাংলাদেশের কতিপয় বোকাচণ্ডাল মানুষ তখন এই অস্ত্রটাকে বিশ্বাসই করে নি।  ইহাকে পারলৌকিক গজব ভেবে প্রথমে তাচ্ছিল্য করছিল, এরপর অস্বীকার করছিল এরপর হঠাৎ করেই মসজিদগুলাতে ভিড় বাড়িয়ে দিয়েছিল। করোনার কালে বাংলাদেশের সবচেয়ে চার্মিং ঘটনা হল শুক্রবারের নামাজীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া! আর তার একমাত্র কারণ ছিল একদল আন্ধা টাইপ কাঠমোল্লার গন্ধমদির মোটিভেশন..."

"ভেবে দেখুন, এই বাঙালির কাঠমোল্লারা যদি বদরের যুদ্ধে অংশ নিত, এরা তখন কী করত? যুদ্ধের ময়দানে না গিয়ে, অস্ত্রপাতি ফেলে দিয়ে মসজিদে গিয়া দোয়া ধরত। নবীজি নিজে যখন জিহাদের সময় জিহাদ করতে বলছেন, এরা তখনও ঘুমায়। রামায়ের কুম্ভকর্ণের কতো ঝিমায়!"

পরবর্তী দুইদিন হাতিমপুরেই ছিলাম। ভিডিওটা সারা গ্রামের ছড়িয়ে গিয়েছিল। হাতিমপুরের অধিকাংশ মানুষেই তখন আতা ভাইয়ের নামে "ছিঃ-চিৎকার!" দিচ্ছিল। 

"এই গণির বেটা আতাউল্লাহ এলাকায় লুচ্চামি করে লন্ডন গেছে। লন্ডন গিয়ে নাস্তিক হয়ে গেছে। মোল্লাদের বিরুদ্ধে ভিডিও ছাড়ছে।" 

 নসু গ্রুপের নেতনেতৃত্বে ভরা বাজারে আতাউল্লাহর নামে কুশপুত্তলি পুড়ানো হল।

 খালেদের পুত্র নসু এখন হাতিমপুরের চেয়ারম্যান। এলাকায় দরিদ্র-অভুক্তদের নামে ত্রাণ এসেছে একশ বস্তা। নব্বই বস্তা গেছে নসুর গোডাউনে। দশ বস্তা যাচ্ছে দুঃস্থজনের হাতে। গ্রামের মানুষ নসুর নামে ধন্য ধন্য করছে। ফেসবুকে ত্রাণ কার্যের ছবি আপলোড হচ্ছে। আহা কী দৃশ্য, নসু তো নয়, যেন মূর্তিমান হাতেম তাই!!!

আতা ভাইয়ের টাইমলাইনে গিয়ে দীর্ঘদিন পর লীনা আপুকে দেখলাম৷ লীনা আপু এখনো স্নিগ্ধ। এখনো ওর চেহারায় একটা নিষ্পাপ কিশোরী কিশোরী ছাপ।

 আতা ভাই এবং লীনা আপুর বাচ্চাদের  ছবি দেখলাম। চায়না পুতুলের মতো দেখতে খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। বড় বড় চোখ, রেশমের মতো ঝুটিবাঁধা চুল। বয়স প্রায় পাঁচ বছর। 
আর বছর একটা ছেলে। ছেলেটার মুখের গড়ন অবিকল গণিউল্লার মতো। ফর্সা মুখ, উন্নত নাক, ঘনকালো চুল। দুষ্টামি ভরা হাসি হাসি মুখ।

 গণি উল্লাহর নাতিদের জন্ম হয়েছে লন্ডনে। জীবনের রঙমাখা দিনগুলি ওরা হয়ত লন্ডনেই কাটবে। এইদেশে কখনো ওরা আসবে না। আসার উপায়ও নেই। তাতে অবশ্যি হাতিমপুরের কারও কিচ্ছু আসে যায় না।
 নসুর পুত্র ননীর বয়স সতের। পিতাদের পায়ের রেখা অনুসরণ করে সে এখনই মদ-খাঞ্জার দোকান খুলে বসেছে। 
হাতিমপুরের ভবিষ্যৎ কান্ডারী হাতিমপুরই আছে। 
  নিয়তির মতোই অটল ও বহাল তবিয়তে টিকে আছে... ঠিকে থাকবে আরও হয়তো সুদীর্ঘ মহাকাল ভরে... এইসব গ্রামে গ্রামে... গ্রামান্তরে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com