অবেলায়
প্লেট থেকে শেষ চামচ পায়েশ মুখে দিয়ে দেবার পর মিলির মেজাজ কিছুটা বিগড়ে গেলো।
এতো মজার পায়েশ আসলে এক প্লেট পেটে চালান করে দিলেও কিছু হয় না।
আম্মার হাতের যে এই পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ খাবার সেটা নিয়ে মিলির কোন সন্দেহই নেই।
ওর ক্ষমতা থাকলে ও অবশ্যই আম্মার হাত প্লাটিনাম দিয়ে বাঁধাই করে দিতো।
স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা ওল্ড কনসেপ্ট, আম্মা একজন আধুনিক মহিলা।
ওল্ড জিনিসপত্র দিয়ে আসলে হবেনা এই চিন্তা করতে করতে মিলি রান্নাঘরে চলে গেলো।
ঘরে মেহমান গিজগিজ করছে। ভাগ্য অতিসুপ্রসন্ন না
হলে আসলে পাতিলে পায়েশের ছিঁটেফোঁটা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
পায়েশ মিলির আম্মার হিট আইটেম।
রূপালী সিঙ্কে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলটা কাত হয়ে পড়ে আছে।
পাতিল কে গড়ের মাঠ বলার কোন সিস্টেম থাকলে এই উপমাটা এখানে একদম ঠিকঠাক হতো।
আম্মা তার শোবার ঘরে মামীর সাথে মহা আনন্দে গল্প করছেন।
মিলি ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, যেয়ে একটু ঘ্যানঘ্যান করে আসবে কি না।
মিলির বড় ভাইয়ের ধারণা মিলি আগের জন্মে মশা ছিলো।
তা না হলে নাকি কারো এত অসাধারণ ঘ্যানঘ্যান করার ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসারই কথা না।
মশা না ছাই! দুনিয়ার সবার সাথে তো মিলি মোটেও ঘ্যানঘ্যান করে না।
শুধু আব্বার সাথে করে। আব্বা ছাড়া তাকে আসলে বাসায় তেমন কেউ পাত্তাও দেয়না।
ভাইয়া দেখলেই নাক কুঁচকে ঠোঁট উলটে বলবে আহ্লাদী করা ছাড়া অন্য যে
কোন কাজ থাকলে কাছে আসতে পারিস। নাহলে ১০০ হাত দূরে থাক।
আর আম্মার ব্যাপারটা মিলি ঠিক ধরতে পারে না।
মাঝেমাঝে মনে হয় আম্মা তাকে আসলে ভালোইবাসে, কিন্তু দিনের
বেশীরভাগ সময় আসলে আম্মা তাকে নিয়ে এতো অভিযোগ করতে থাকে,
মিলির তখন মনে হয় আসলে ভাইয়ার কথাই ঠিক।
তাকে আসলেই কোন একটা ডাস্টবিনে হাত পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি করতে দেখে
আম্মা নিতান্তই দয়াপরেবশ হয়ে তাকে তুলে এনেছে, এবং লাইফবয় সাবান
দিয়ে আচ্ছামত ডলে গোসল দিয়ে এই বাসায় থাকার জায়গাটা টুকু দিয়েছে।
ড্রইং রুমে উঁকি দিতেই মিলির খুশিতে মুখের সব গুলো দাঁত বের হয়ে গেলো।
আব্বার হাতে প্লেট ভরা পায়েশ। ভাইয়া আর মামাতো ভাই তাদের বাটি সামলাচ্ছে।
মিলির দিকে চোখ পড়তেই ভাইয়া বাঁকা হাসি হাসলো। কিরে লোভী, গন্ধ শুঁকে শুঁকে চলে এলি?
-একদম বাজে কথা বলবা না ভাইয়া, পুরো বাসা কি তোমার একার? আমি যখন ইচ্ছে যে রুমে যেতে পারি, হ্যাহ!
তা তো দেখতেই পাচ্ছি, এখনই তো আব্বার প্লেট থেকে খেতে শুরু করবি, তোকে কি আমি চিনি না?
ভাইয়া কে ভেংচি কেটে দেয়ার তুমূল লোভ সামলিয়ে আব্বার পাশে বসে পড়লো মিলি। আব্বা তাকে আসলেই বেশি ভালোবাসে দেখে ভাইয়ার যে হিংসে হয় তা কি মিলি জানে না? খুব জানে! আব্বা যখন হাত ধরে টেনে কাছে বসালেন, এতোক্ষনের সবকিছু মিলি ভুলে গেলো। ভাইয়া কে কি কি মজা দেখানো যেতে পারে সেই প্ল্যান, আম্মা যে তাকে ভালোবাসে না সেই দুঃখে একদিন অনেক দূরে চলে যাবার চিন্তা, আগামীকাল পরীক্ষার খাতা দিলে কি কি আযাব হতে পারে সব ভুলে গেলো ও।
আব্বা বেশিরভাগ সময় মিলিকে নিজ হাতে খাইয়ে দেন। এক চামচ পায়েশ তুলে মিলির মুখে দিতেই মিলির চোখে পানি এলো। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে ও অনেক অনেক অনেকদিন পর এরকম আব্বার এতোটা পাশে বসে আছে। ঠিক কত বছর যেন এই মুহুর্তের জন্য অপেক্ষায় ছিলো ও… ঠিক কতোটা তৃষ্ণার্ত ছিলো…
চোখ খুলে মিলি ঠিক ঠাওর করতে পারলো না কয়টা বাজে।
অবেলায় ঘুমিয়ে গেলে খুব অস্থির লাগতে থাকে।
সন্ধ্যা না ভোর বুঝে উঠতে কিছু সময় লেগে যায়, মাথায় থাকে ভোঁতা এক ধরনের ব্যাথা।
কড়া লিকারের এক কাপ চা হলে আসলে এই হতচ্ছাড়া মাথা ব্যাথা কমবে না!
চকিতে মিলির মনে পড়ে যায়, আব্বা! আব্বা এসেছেন বাসায়!
মাথা ব্যাথা ছাপিয়ে মিলির বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠে।
It was just a dream! It was just a beautiful dream…
চলে যাওয়া মানুষেরা কখনো ফেরে না এই তেতো সত্যকে বুকের মাঝে চেপে
ধরে অনেকগুলো শীত পেরিয়ে গেছে। খুব সন্তপর্ণে অশ্রু মুছে মিলি রান্নাঘরের দিকে এগোয়।
– নূহা চৌধুরী
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com