Breaking News

ছায়াময়

আমি তাকে যেভাবে লক্ষ্য করেছিলাম সেভাবে হাজার ও মানুষ প্রতিদিন কাউকে না
কাউকে হয়তো লক্ষ্য করে। গোল একটা ঘরে তার ছোট্ট ছবিটা জ্বল জ্বল করে।
আমার মনে পড়ে আমি তাকে এক ঘর ভর্তি আনন্দ আর তারাবাতির মধ্যে দেখেছিলাম।
আবার সেদিন মেঘ করে করে বিকেলে ধানমন্ডির বেঙ্গল বই আর
গরম সিঙ্গারার ধোঁয়ার ফাঁকতালে আবছামত সে ছিলো। তার উপস্থিতি আমি টের পাই।
তাকে আমাদের মত করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে দেখিনি।
গিটারের টুংটাং ঘাড় দুলিয়ে রাজবুলবুলির মত তাকে দেখিনি গলা
মেলাতে কিন্তু তার ডান হাতের যে তর্জনী আছে, টুকটুক করে তা টেবিলে তাল ধরছিলো।
তার নাম আমি দিতে চেয়েছিলাম অরিন্দম। কিন্তু কেন যেন মনে হলো
তাকে আমার অন্য নামে ডাকতে হবে। অরিন্দম শব্দের অর্থ জয়ী। আমার মনে হচ্ছিলো,
এই যে আমাদের খাঁক হয়ে পোড়া জলের মত মন, তা কি সে জয় করে নিতে পারবে?
তৃষিত পাখির মত আমি বন্ধুদের পরের আড্ডায় গেলাম। তার পরের আড্ডায় ও।
আমার মনে তখন লু হাওয়া। তীব্র দাহে পুড়ছি। অরিন্দম আজ আসবে?
কথা বলবে আজ? অরিন্দম প্রতি আড্ডায় আসে।
গোল গোল চায়ের কাপ পেরিয়ে গেরুয়া চানাচুর আর বিস্কিটে সবার সাথে তার হাত ডুবে না, আমি
ভেবেছিলাম বিস্কিট নেবার ছলে ও বোধহয় আমাকে একটু ছুঁয়ে দিবে…
এমন করে আমাকে এর আগে কেউ কি দেখেছিলো? ও যেন কিছু বলতে চায়…
যেন শত বছরের না বলা কথা এক শ্রাবণের বৃষ্টির মত মুহু মুহু করে ছড়িয়ে দিতে চায় …
কিন্তু অরিন্দম আমার সাথে কথা বললো না। আমি সিঁড়ি ঘরে যেয়ে শাড়ির আঁচলে নোনা
ক্লান্তি মুছতে মুছতে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর শৈবালের মত শান্ত দৃষ্টি আমার আঁচল ছুঁয়ে আছে।
তোতন আমার বেশ ভাল বন্ধু। অরিন্দমকে আমার সাথে সাথে ও যে লক্ষ্য করছিলো তা আমার
অতি সতর্ক চোখে ধরা পড়েনি। মাঝেমাঝে এমন হয়েই বুঝি যায়। যা কিছু লুকাতে চাই আমরা
তাই চোখের পলকে ভাসে! তোতন আমার মাথায় টোকা দিয়ে বললো, এই শাওলী হচ্ছে কি?
ওই সাদা ম্যাড়ম্যাড়ে বকটা তোর দিকে এমন করে তাকায় কেন? আমি চমকে উঠে তোতনকে বললাম,
ধ্যাত! তোর যত বাজে কথা… তোতন মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বেড়িয়ে গেলো। আমার কথায় চিড়ে মুড়ি কিচ্ছুটি
ভিজেনি। আমি তাকিয়ে তোতনের সাদা বকের দিকে তাকালাম। সে চোখ নামিয়ে
নিলো আর আমি ভেবে নিলাম ধুর এভাবে হয় নাকি…
অরিন্দমের কথা ভেবে ভেবে আমার রাতের ঘুম পালালো, ঠান্ডা হলো কফির মগ, বেলী গাছ আমার অপেক্ষায় থেকে থেকে হলদে হলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেমন করে অরিন্দমকে হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে আকাশ দেখা যাবে? অরিন্দমের সাথে হলুদ দালান বিউটিবোর্ডিং যাবো, অরিন্দম আর আমি এক নদী পাড়ি দিবো এক সাথে এমন উদ্ভট বেখেয়ালে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে মনে একটা দালান তুলছিলাম ওকে নিয়ে। প্রত্যেকবার দেখা হয়ে যাচ্ছিলো, দালান হয়ে যাচ্ছিলো তাসের ঘর। ও যেন মূক। কেবলই দেখে। আর চাওয়ার কিছু নেই।
আজ একটু মাঠ পেরিয়ে জলের দেশে চলে যাবো। আমার সমুদ্র ভীষণ ভাল লাগে। আমার নতুন বাড়ি সমুদ্রের একটু কাছেই। কয়েক বছরের জন্য চলে যেতে হবে ভেবে একটু মন দোনমন করছে। আবার সমুদ্রের ভেজা বালির উম পাওয়ার জন্য ও তর সইছেনা। আমার মন বলছিলো অরিন্দম আমাকে বিদায় দিতে আসবে। এয়ারপোর্টে দরজা পেরিয়ে চলে যেতে যেতে চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে দেখলাম। বাইরে তখন তীব্র আঁধার। অরিন্দম আসেনি। জয়ী শব্দটা আসলেই ওর জন্য ছিলো না। অরিন্দমের জন্য আমি নতুন নাম দিলাম ছায়াময়। অন্ধকারে যাকে দেখা যায়না।
– নূহা চৌধুরী

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com