কেউ কিছুই জানে না | পর্ব- ০২
ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে আমার হলের রুমে আবিষ্কার করলাম।
আমি তো ক্যাম্পাসে ছিলাম, রুমে আসলাম কিভাবে?
অসহ্য মাথার যন্ত্রনায় ভালো করে তাকাতেও পারছিনা।
মাথায় কে যেনো পানি ঢালছে। হয়তো জিনিয়া।
পৃথিবীটা কতো অদ্ভুত! আমি যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে হয়তো শুধু ঘৃণাই করে।
ভালোবাসা কি এমনই হয়?
রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর এলো। জিনিয়া মনে হলো অনেকক্ষণ কপালে
জলপট্টি দিয়েছে। হল লাইফে রুমমেটের থেকে বিন্দু পরিমান সেবাও
যেন এক সমুদ্রের সমতুল্য!
আমার জ্বরের সপ্তম দিন মনে হলো আমি জীবিত আছি। আমার জীবনে
এমন ভয়াবহ জ্বর কখনো হয়নি। কাল পর্যন্ত নাকি ১০৪ এবং ১০৩ এ উঠানামা
করছিলো। গতরাতে মনে হলো কমেছে কিছুটা। আজকে সকালের দিকে
নিজেই মাপলাম ১০১ এর একটু বেশি। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম তেমন
কোনো ফোনকল কিংবা এসএমএস ও আসে নি। কল নেই কারণ
জিনিয়া রিসিভ করেছিলো। আর আজকে একটা কল শুধু ভাইয়ার নাম্বার
থেকে। কয়েকটা এসএমএস আসছে যেগুলো সিম কোম্পানির। আচ্ছা
আমার বাবা মা এমন কেন! আশ্চর্য! আমি অসুস্থ জেনেও কেন তারা আসলো
না? আমি যে হলে খুব ভালো আছি তা আমার বাবা মা শতভাগ নিশ্চিত! সত্যি
কি বাবা মায়ের থেকে দূরে ভালো থাকে কোনো সন্তান? ব্যস্ত মা বাবার সন্তান
হওয়ার থেকে কষ্টের কি আর কিছু আছে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা বালিশের
কাছে রাখলাম। পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক মানুষ তাদের জীবন খুব সুন্দর করে উপভোগ করতে পারে।
আমার মতো অভাগার কাছে প্রিয় মানুষের সাথে মাত্র কিছু সময় কাটানোই
যথেষ্ট মন খুলে হাসার জন্য!
অনিককে নিয়ে ভাবার মতো অবস্থায় এতদিন না থাকলেও এখন থেকে অনিক
শব্দটা আবারও মাথায় ঘুরতে শুরু করেছে। কে জানে কি আছে শেষে!
বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। সন্ধ্যে হয়েছে সবে। জিনিয়া বারান্দায় হাটাহাটি করছিলো।
আমাকে দেখে বললো,
.
-“আজকে কেমন লাগছে? জ্বর সেরেছে?”
-“হ্যা”
-“ক্লাসে কবে যাবি? পুরো দেড় সপ্তাহ ক্লাস করছিস না। সেমিস্টার ফাইনালের
ও আর দেরি নাই”
-“দেখি কাল থেকে যাবো”
-” ওইদিন সূর্যের দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন?
অনেকে বলাবলি করছিলো অনিক ভাইয়া আর তার বন্ধুরা নাকি তোকে কি কি বলেছিল
তারপর তুই সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলে। আশ্চর্য! তুই কি পাগল নাকি নিশু? ওইদিন
তোর চোখদুটো দেখে কি পরিমাণ ভয় পেয়েছি কিভাবে বুঝাবো তোকে। আমার মনে হয়,
তুই অনিককে প্রপোজ করেছিস আর সে তোকে এই পানিশমেন্ট দিয়েছে।
তাই না?”
আমি কিছুই বললাম না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের পানে তাকিয়ে রইলাম।
জিনিয়া আবারো বললো,
-“আচ্ছা সে অন্য মেয়েরা প্রপোজ করলে দু’চারটা কথা
শোনায় কিন্তু তোমার সাথে কেন এমন করেছে সেটাই বুঝলাম না আমি।”
আশ্চর্য আমাকেও এ বিষয়টা ভাবায়নি। ভালোবাসার কথা বললে পানিশমেন্ট পেতে হবে?
এরপর কেটে গেলো পুরো একটা মাস। অনিকের সাথেও এরমাঝে প্রায়ই দেখা
হয়েছে। আমিও হাল ছাড়িনি। স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে মেশার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি।
অনেক দিন নিজে যেচে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। বিনিময়ে হয়
সে আমাকে পাত্তা না দিয়ে চলে গিয়েছে নয়তো সবার সামনে নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে
বলে সম্বোধন করেছে। একদিন তো সে বলেই বসলো,
– “এই পর্যন্ত অনেক মেয়েই আমাকে ভালোবেসেছে কিন্তু কেউ তোমার মতো ছ্যাঁছড়ামি করে নি।
রিজেক্ট হওয়ার পর চলে গিয়েছে। তুমি কেন এখনো আমার পিছনে পড়ে আছো?”
আমি একটুও রাগ অভিমান না করে বললাম,
-“কারণ আমি অন্যরা না। আমি নিশু আপনাকে ভালোবাসি, ভালোবেসেছি, ভালোবেসেই যাবো।”
-“যত্তসব”
এরকম চলতেই লাগলো। আমি অবাক হলাম এই ছেলে একদিন আমাকে
পানিশমেন্ট দিয়ে শান্ত হয়নি। আরও অনেক পানিশমেন্ট দিয়েছে তার মধ্যে দু’একটা
যা আমি জীবনেও কল্পনা করতে পারিনি। সেদিন ছিলো র্যাগ ডে। রঙ এ
পুরো মাখামাখি আমরা সবাই। হঠাৎ আমাকে অনিক ডাকলো।
আমি খুশিতে লাফিয়ে গেলাম ওর কাছে। ওর কাছে যেতেই অনিক
আমার হাতে একটা থালা ধরিয়ে বললো,
-” যাও গিয়ে ক্যাম্পাসের সবার কাছে ভিক্ষে চাও”
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম,
-“মানে?”
-“যা বলছি তাই। যদি একটুও চালাকি করো তবে এরচেয়ে খুব খারাপ র্যাগ দিবো তোমাকে।”
আমি অসহায়ের মতো কাঁদতে লাগলাম।
অবাক করা বিষয় এতে সবার কি হাসি।
নিজেকে সার্কাসের কোনো জন্ত মনে হচ্ছিলো আমার।
যেন আমি সবাইকে মজা দেখাচ্ছি। আমি কি সত্যিই জোকার?
রাগে অভিমানে এরপর অনেকদিন ভার্সিটিতে যাইনি। মাঝে একদিন
শুধু গিয়েছিলাম বিদায় অনুষ্ঠানের দিন। তাও অনিককেই দেখার জন্য।
ভালো লাগার ব্যাপার অনিক সেদিন আমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ বা র্যাগ দেয় নি।
আবার তেমন কথাও বলেনি। শুধু আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন আছেন উত্তরে
একটা হাসি দিয়ে বললো ভালো। কি জাদুকরী তার হাসি। তার এই হাসিটাই
আমাকে খুন করার জন্য যথেষ্ট! এই হাসিটার জন্যই শুধুমাত্র ক্ষনিকের জন্য
আমি একটু আশা খুঁজে পেয়েছিলাম।
সময়, দিনগুলো চলতেই থাকলো। আমি তেমন একটা ক্লাস করতাম না
ভার্সিটিতে যেতাম তাকে দেখার জন্য। মাঝেমধ্যে দেখা হতো বেশিরভাগ
দিনই দেখা হতো না। আমি ক্যাম্পাসে হাটতাম আর তার কথাই ভাবতাম।
ক্লাস করলেও কন্সেনট্রেশান ছিলো না। পড়াশোনা একদম অসহ্য লাগত আমার।
ভেবেছিলাম পরীক্ষার সময় হয়তো ভার্সিটিতে শেষ বারের মতো অনিকের
সাথে দেখা হবে তাও হলো না। সব গুলো এক্সামই খুব বাজে দিলাম।
এক্সামের পর সেমিস্টার ব্রেকে বাসায় গেলাম। বাসায় এসে আরও একাকিত্ব
বোধ করছিলাম আমি। আমাদের ব্যস্ত পরিবারের আমরা চার সদস্য।
আমি বাবা মা আর ভাইয়া। ভাইয়ার সাথে আমার খুব কম দেখা হয় কারণ
সে চট্টগ্রামে বনবিভাগে জব করে। আর সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি
বাবা মা অফিসে। আমার এই জীবনে আমি খুব একা। বাবা মায়ের অঢেল টাকা
থাকায় শুধু মাত্র এই টাকা জিনিসটাই না চাইতেই পেয়েছি আমি।
কিন্তু যা চাই তা পাওয়া হয়ে উঠে না। একটু ভালোবাসা, একটু সময়
চেয়েছিলাম সেটা আর পেলাম না তাদের ব্যস্ত কর্মমুখী জীবনযাপনের কারনে।
.
ছুটি কাটিয়ে হলে আসার পরপরই রেজাল্ট দিলো। আমি খুব বাজে রেজাল্ট করলাম।
জিপিএ ৩ পয়েন্ট ও আসে নি। অনিকের খোজ নিয়ে জানলাম তার সিজিপিএ ৩.৯+।
আমার যে কি খুশি, নিজে এত বাজে রেজাল্ট করলাম তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাই নেই।
নতুন সেমিস্টারের ক্লাস পুরোদমে চলতে লাগলো। আমি তখনও অনিকের স্বপ্নে বিভোর।
পার্থক্য একটাই আগে ভয়ে থাকতাম সে কখন কি করে বসে আর এখন দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস তার সাথে আমার দেখাই হয় না। আমি ও অপেক্ষা করে থাকি তার
, হয়তো একদিন সে আসবে। আমাকে অনুভব করবে। হয়তো একদিন সে নিজে
আমাকে খুজবে। আমি অপেক্ষায়ই থাকি। আমার একটু হলেও বিশ্বাস হতো আমি
আমার ভালোবাসার যুদ্ধে বিজয়ী হবো।
এই সেমিস্টারের শেষের দিকে অনিককে ভার্সিটিতে দেখলাম। সেই ফর্সা চেহারা,
মাথাভর্তি খাড়া খাড়া চুল, ছোট ছোট চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। চশমার গ্লাসটা
আগের চেয়েও ঘোলা। চোখের সমস্যা বেড়েছে হয়তো। এতদিন পর তাকে দেখেই
কিভাবে যেন ছুটে চলে গেলাম তার সামনে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি আমি।
একদম তার কাছে গিয়েই বললাম,
-“এতদিন পর আসলেন তাহলে?”
আমাকে দেখে তার কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
-“কেন কথা ছিলো নাকি আসার?”
-“আপনার কি একটুও মনে হয় না যে কেউ একজন আপনার অপেক্ষায় থাকে?”
-“না!”
কথাটা বলেই সে হনহন করে চলে গেলো। আমি স্থির দাড়িয়ে রইলাম। চোখের
পানি টলমল করছে। এতোটাই কি নগন্য আমি? যাকে একটু ভালোবাসা যায় না,
একটু ভালো ব্যবহার করা যায় না, একটু সময় দেয়া যায় না? আশ্চর্য! শালা তোরে
আমি একবার পাই, ইগনোর করা শেখাবো!
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com