গল্পঃ ভাবনা | পর্ব - ৪র্থ
বৌমা তবে কোথায় গেল হাসান? বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে জিজ্ঞেস করলেন কথাটা। তার কথায় দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাজ করছে মনে হয়। তিনি আমার কাছে এসে মুখটা স্পর্শ করে বললেন, একটা সহজ সরল গ্রামের মেয়ে কোথায় হারিয়ে যাবে। বলতে পারিস? যে কি-না শহরে নতুন! পথ ঘাট এখনো ভালো করে চিনে উঠতে পারেনি। ডাকাত এসে ডাকাতি করে নিয়ে গেছে মানলাম কিন্তু ওরা তো বৌমা কে নিয়ে যায়নি? তাও কি সম্ভব!
আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম বাবা! আপনি, আপনিও কি আমাকে সন্দেহ করছেন? বাবা চোখের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলেন, আমরা অনেক সময় অনেক কিছু করতে চাই না। তবুও সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের হাতে ঘটে যায়! সেরকম কিছু ঘটে থাকলে আমায় বল বাবা! আমি তোর বাবা!
আমি এতোটাই অবাক হলাম যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে কথা গুলো আমার বাবার মুখে আমি শুনছি! নিজেকে এতোটা অসহায় মনে হচ্ছে যে, পৃথিবীতে এই মাত্র এসে নামলাম। সবকিছু অচেনা অপরিচিত! আমি চুপ করে রইলাম। কি বলবো আমার নিজের বাবা আমাকে সন্দেহ করেছে আর কি বলার থাকে। বাবা আমাকে চুপ দেখে বললেন আমি জানি আমার ছেলেমেয়েদের এমন শিক্ষা আমি দেইনি কিন্তু তবুও ভুল হয়ে যায়! মানুষ ভুল করে ফেলে নিজের অজান্তেই!
কিন্তু তোর মুখে স্পর্শ করে বুঝতে চাইলাম আমার অন্তর কি বলে। যাই হোক তোর এতোবড় একটা বিপদ গেলো আরও আগেই আমাকে তোর খবর দেওয়া উচিত ছিল। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস? নিয়মিত অফিস যাস? নাহ বাবা! যা ঘটে গেছে তার একটা না একটা ফল আসবেই তার জন্য চাকরি গেলে হবে বাবা? আমি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললাম, বাবা চাকরিটা আর বুঝি থাকবেনা আমার!
আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বাবা, কেন থাকবেনা? সব শুনতে চেয়োনা বাবা! কেন রে বুড়ো হয়েছি বলে আস্তে আস্তে সবকিছু থেকে সরে যেতে হবে? সে নাহয় গেলাম কিন্তু সন্তানের বিপদের দিনে তো সরে যেতে পারবোনা! সন্তানের বিপদে শক্তি সাহস যোগাবার সামর্থ্য এখনো হয়তো শেষ হয়ে যায়নি বাবা! সব খুলে বল আমায়। আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। বললাম বাবা তুমি এমনিতেই অনেক টেনশনে থাকো ওদের লেখা পড়ার জন্য। এখন আমার জন্যও যদি তোমার টেনশনে পড়তে হয় সেটা আমি কি করে সইবো? তবুও বল আমায়। সব খুলে বলাতে বাবার মুখের উপর কালো ছায়া নেমে এলো।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন কতদিনের সময় দিয়েছে? জ্বি সপ্তাহ খানেক। আচ্ছা আজ আমি আসিরে। আমি পিছনে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম বাবা! আমার মুখের উপর হাত বুলিয়ে কি বুঝতে পারলে? বাবা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমার ছেলেটা সত্যি খুব বিপদের মধ্যে আছে। চলি বাবা! নিজের প্রতি খেয়াল রাখিস আর কোন প্রয়োজন হলে বুড়ো বাপকে অযোগ্য মনে করিস না! বাবা চলে গেলেন কিন্তু কেন জানি পিছনে ডাকতে আর সাহস হলোনা।
আমি অনেক রাতে দেওয়ালের ওপারে গিয়ে কান পেতে রইলাম মহিলার রুমের কাছে। যদি কিছু শুনতে পাই। কিন্তু শুধু নাক নাক ডাকার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শুনতে পেলাম না! তাই দেওয়াল টপকে আবার নিজের রুমে চলে এলাম। মাথায় কিছু ঢুকছে না। এই ঘটনাতে মহিলার আগমন কাকতালীয় নাকি পরিকল্পিত? সে কি সব জানে! মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে সে আমাকে এখানে ধরিয়ে দিতে চাইছে। তাকে তো আগে কখনোই দেখিনি?
তবে কেন সে আমার পিছু নিয়েছে। আবার আড়ালে আমার উপর নজর রাখে!
তবে কেন সে আমার পিছু নিয়েছে। আবার আড়ালে আমার উপর নজর রাখে!
দুদিন পরে পুলিশের ডাক পড়লো। গেলাম ছুটে। এবার ছোট বাবু নয়। স্বয়ং থানার বড় বাবু আমাকে সঙে নিয়ে একটি খালি কক্ষে গেলেন। টেবিলের উপর তার মোটা রুলটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জানেন এর এক একটি আঘাতে কেমন যন্ত্রণা হয়? আমি বললাম না স্যার! তিনি বললেন প্রফেশনাল ক্রিমিনাল যারা তারাই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গরগর করে সব সত্যি বলে যায়। এখন বলুন সব সত্যি স্বীকার করবেন নাকি এটার ব্যাবহার আমাকে করতে হবে? যদিও আমি এটা ব্যাবহার করতে চাই না, কিন্তু একবার চালু করে দিলে থামি না!
তার কথা শুনে আমার কলিজা এবং গলা দুটোই শুকিয়ে কাঠ! বুঝতে পারলাম আজ এরা এতো সহজে আমাকে ছাড়বেনা। কিন্তু তবুও আমি আমার কথার উপর অটল রইলাম। স্যার বলেছি তো আমি যা জানি। তারচেয়ে আমি বেশি কিছু জানিনা, বিশ্বাস করুন স্যার! বড় বাবু হেঁসে বললেন, আমি জানতাম এতো সহজে তুই কিছু স্বীকার করবি না! অন্য পদ্ধতিতে স্বীকার করাতে হবে।
কি আর করা, এই ওকে দেওয়ালের কাছে নিয়ে ইচ্ছে মতো ধোলাই কর! আমি চিৎকার করে বললাম স্যার মারবেন না, আমি সত্যি এর বেশি জানিনা।
কিন্তু শুনলোনা আমার কথা কেউ। ইচ্ছে মতো ধোলাই শুরু হলো।মনে হচ্ছে জীবনটা বুঝি বেরিয়ে যাবে। স্যার! স্যার বলছি মারতে নিষেধ করুন। আমি ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললাম স্যার সত্যি বললে আর মারবেন না তো? আচ্ছা ঠিক আছে আর মারা হবে না। কি সত্যি সেটাই বল? এমন সময় আরেকটি অফিসার উপস্থিত হয়ে কিছু কাগজ পত্র ও ভাবনার মোবাইল ফোন দিয়ে গেল।
বড় বাবু আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা নিশ্চয়ই চিনতে পারছিস কার মোবাইল? আমি স্বাীকার করলাম। এটা ভাবনার মোবাইল ফোন। হুম! পুলিশ অফিসার হেঁসে বললেন, তবে যা সত্যি গরগর করে বলে যা। স্যার সত্যি কথাই বলবো স্যার! সেদিন দুপুর বেলা রাগ করে যখন বাসা থেকে চলে আসি তখন ভাবনার মোবাইলটা কেঁড়ে নিয়ে যাই আমার সাথে করে । তারপর চা, সিগারেট পান করে যখন রাগ একটু কমে তখন চলে এসে দেখি ভাবনা ঘরে নেই। ঘরের সবকিছু ভাঙাচোরা!
তা, মোবাইলের কথা আগে বলিসনি কেন? জ্বি স্যার ভয়ে! এমনিতেই সবাই আমাকে সন্দেহ করছে তাই আর বলতে চেয়েও বলিনি। বড় বাবু বললেন, শোন অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাদের আর নয় ভাবনা কোথায় বলে দে। ভাবনার সাথে তুই কি করেছিস? তাকে মেরে ফেলেছিস? কারণ বোঝাই যাচ্ছে ভাবনা তোর সাথেই ছিলো! আমি আঁতকে উঠে বললাম না স্যার! সে বাসায় ছিলো।
তিনি আমার ঘাড় ধরে কাগজের মধ্যে মুখটা গুঁজে দিয়ে বললেন, ভালো করে দেখে নে। তোর মোবাইল লোকেশন আর ভাবনার মোবাইল লোকেশন এক। তবে ডাকাত তাকে কি করে আক্রমণ করতে পারে? যা করেছিস তুই করেছিস। না স্যার ভাবনার মোবাইল আমার কাছে ছিলো ঠিক কিন্তু পরে আমি সেটাও ভুলে যাই। কখন পকেটে রেখেছি আর সেটা কখন বন্ধ হয়ে গেছে তা আমার মনে ছিলো না! আমি নিজেও তাকে একবার কল দিয়েছি কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে। আর পকেটে মোবাইল আমার একদমই খেয়াল হয়নি। কিন্তু যখন পেয়েছি তখন বের করার পরিস্থিতি ছিলো না। তাই ওটা আমি শহরের শেষ প্রান্তের এক ডাস্টবিনে ফেলে এসেছিলাম। কিন্তু
বুঝতে পারলাম না আপনারা কেমন করে পেলেন?
বুঝতে পারলাম না আপনারা কেমন করে পেলেন?
পুলিশ হেঁসে বললো, এক টোকাই সেটা ব্যাবহার করার জন্য খুলেছিল। আর কল দিতেই আমরা সেটা নিয়ে আসি। যাই হোক মিঃ হাসান আমি ভালো করে বলছি সব স্বীকার করে বলুন ভাবনা কোথায়?
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, স্যার আমি জানিনা। তবুও যদি আপনারা বিশ্বাস না করেন তবে আমাকে ফাঁশিতে ঝুলিয়ে দেন।কেন মিঃ হাসান! ভাবনাকে তাহলে খুন করে ফেলেছেন? হ্যা স্যার যদি তাই মনে করেন তবে প্রমাণ করে দেখান! আমি আর পারছিনা এসব সহ্য করতে। আমার সব গেল। মানসম্মান, টাকা পয়সা, এমনকি বউটাও! আমাকে মারুন কাটুন আমার আর বেচে থাকার ইচ্ছে নেই। আমি বড় ক্লান্ত! বড় বাবু ছোট বাবু কে বললেন, সেখানে ওরা গিয়েছে দেখো সেখানে সি,সি ক্যামেরা আছে কি-না? তাহলে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
তাই করলো। একজন আমাকে আবার মারতে উদ্যত হলে, বড় বাবু নিষেধ করলেন। আমাকে বন্দি করে রাখা হলো।
কয়েক দিন ধরে পুলিশ ইনভেস্টিশন করে আমার বিরুদ্ধে কিছুই পেলনা। যাতে দেখা যায় ভাবনা আমার সাথে ছিলো।
কয়েক দিন ধরে পুলিশ ইনভেস্টিশন করে আমার বিরুদ্ধে কিছুই পেলনা। যাতে দেখা যায় ভাবনা আমার সাথে ছিলো।
পুলিশের বড় বাবু আমাকে বললেন, মিঃ হাসান আপনি দেখছি খুবই চতুর শৃগাল। সহজে ধরা দিবেন না! তবে এটাও বলছি সহজে পাড়ও পাবেননা। আমার ধারণা মিথ্যা হতে পারে না, কাজটা যে আপনার তা যে করেই হোক আমি প্রমাণ করে ছাড়বো। এখনকার মতো যেতে পারেন।
আমার ভাগ্য ভালো আমি যেখানে গিয়েছি সেখানে প্রায় দোকানেই সি,সি ক্যামেরা ছিলো। পুলিশের হাতে কোন শক্ত প্রমাণ লাগেনি। তাই তারা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো।আমি আসার সময় বড় বাবুকে বললাম স্যার! এখন আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ও কারও সাথে পালিয়ে গেছে। তিনি বললেন, যদি পালিয়ে গিয়ে থাকে তবে ঘরে ভাঙচুর করার কি দরকার ছিলো? তার কাছেই তো চাবি ছিলো ইচ্ছে করলেই কষ্ট না করে নিয়ে চুপচাপ চলে যেতে পারতো। তাছাড়া কারও সাথে পালিয়ে গেলে তার সাথে যোগাযোগ করতে হয় কিন্তু আপনার বউয়ের মোবাইলে আপনার ও তার,বাবার বাড়ির নাম্বার ছাড়া কোন কথাই হয়নি!
এখনো বলবেন পালিয়ে গেছে? সত্যি বের হবেই একটু অপেক্ষা করুন! অতি দ্রুতই মনে হচ্ছে আপনার হাতে হাত কড়া পড়াতে পারবো।
আমি চলে এলাম স্থানীয় ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ পত্র নিলাম। দুদিন পরে বাবা! এলেন সাত লাখ টাকা নিয়ে! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পেলে বাবা এতোটাকা? তিনি হেঁসে বললেন, মিতুর বিয়ের জন্য কিছু টাকা জমিয়ে ছিলাম আর কিছু জমি বন্ধক দিয়ে।
আমি চলে এলাম স্থানীয় ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ পত্র নিলাম। দুদিন পরে বাবা! এলেন সাত লাখ টাকা নিয়ে! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পেলে বাবা এতোটাকা? তিনি হেঁসে বললেন, মিতুর বিয়ের জন্য কিছু টাকা জমিয়ে ছিলাম আর কিছু জমি বন্ধক দিয়ে।
আমি তার পায়ের কাছে বসে, বললাম কিন্তু বাবা! মিতুর বিয়ের কি হবে? সে এখনো খুব বেশি বড় হয়ে যায়নি। আমার আশা ততদিনে তুই একটা ব্যাবস্থা করে ফেলতে পারবি। বাবা আমাকে নিয়ে গিয়ে বসের হাতে পায়ে ধরে চাকরিতে বহাল করে দিয়ে গেলেন। পুলিশের সন্দেহ আমার উপর থেকে সরে যায়নি কিন্তু তারা কোন প্রমাণ না পেয়ে কিছু করছেনা। শুধু মাঝে মাঝে তলব করে। আমিও দেখা করে চলে আসি। ভাবনার সোশাল একাউন্টেও কিছু আবিষ্কার করতে পারলোনা পুলিশ।
তাই আমার উপর নজর রাখা পর্যন্তই। ভাবনার বাড়ি থেকেও কেউ এসে থানায় তাগাদা করে না। যেন মেয়ের শোক একদিনেই তাদের শেষ হয়ে গেছে! শুধু আমার শাস্তিই শেষ হচ্ছে না। এখন মাঝে মাঝে ভাবি ভাবনা যেন ইচ্ছে করেই আমার সাথে ঝগড়া ঝামেলা সৃষ্টি করতো। যেন আমার কাছে থেকে দূরে থাকতে পারে।
তবুও আমি ভাবনাকে ভুলতে পারছিনা। একটা মানুষ কেমন করে হাওয়া হয়ে গেল!
তবুও আমি ভাবনাকে ভুলতে পারছিনা। একটা মানুষ কেমন করে হাওয়া হয়ে গেল!
আজ অফিসে যাবো হঠাৎই খেয়াল করলাম একটা মানুষ বাইনোকুলার দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তিন চারশো গজের কম হবেনা। পাঁচ তলা বিল্ডিং! তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে বাইনোকুলার দিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে। যাই আমাকে কেন দেখবে? এমনিতেই হয়তো নতুন কিনেছে তাই শখ পূরণ করছে।
অফিস চলে গেলাম। এরপর কয়েকদিন খেয়াল করলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে আমাকে কেউ দেখছে। ভাবলাম পুলিশের লোক!
অফিস চলে গেলাম। এরপর কয়েকদিন খেয়াল করলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে আমাকে কেউ দেখছে। ভাবলাম পুলিশের লোক!
কিন্তু যখন প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়তে লাগলো। তখন আমি একটা বাইনোকুলার কিনে আনলাম। এবার দেখি কে?
চলবে,……………..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com