গল্পঃ তোমাকে বুঝিনা প্রিয়
এই যে, ইঁদুর ছানা! ভার্সিটি কি সেজেগুজে আসার জায়গা?? এভাবে সঙ সেজেছো কেন? আর এটা কি পড়েছো, শাড়ি? আমার তো মনে হচ্ছে ছেলেদের পেট-পিঠ আর নাভি দেখানোর ফন্দি এঁটেছো। এভাবে ছেলেদের ইম্প্রেস করতে চাও বুঝি??
নিশ্চুপ খুশবু শুধু রাবিতের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকালো। অন্য কেউ কথাটা বললে হয়তো এক ঘুষিতে তাকে ফোঁকলা বানিয়ে দিত। কিন্তু রাবিত বলেছে কথাটা, তাই তার হাতটা নড়ছে না। এমনটা নয় যে, রাবিত তাদের ভার্সিটির পলিটিশিয়ান লিডার বলে তাকে ভয় পাচ্ছে। খুশবু মোটেও রাবিত কে ভয় পাচ্ছে না। কিন্তু রাবিতের সামনে এলেই তার কাঁপুনি শুরু হয়। সে এক ভয়ংকর কাঁপুনি! তার সারা শরীরে ভূমিকম্প হয়। গলা শুকিয়ে যায়। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মাথা ঝিমঝিম করে। মনে হয় যেন এক্ষুণি সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। যার কারণে রাবিত তাকে একটা নামও দিয়েছে, “ইঁদুর ছানা”! আবার কখনো কখনো “ভিতুর ডিমমম“ বলে মেঘের গর্জনের মতো করে ডেকে উঠে। তখন তার অন্তরাত্মা লাফিয়ে উঠে। তার হার্টের সমস্যা থাকলে হয়তো কবেই ছোট খাটো স্ট্রোক হয়ে যেত। স্ট্রোকের কথা চিন্তা করতেই রাবিত তাকে স্ট্রোক করার মতো একটা কথা শুনিয়ে দেয়।
—- কিন্তু শাড়িতে বেশ লাগছে তো! একদম ইঁদুর ছানা লাগছে না। সবুজ শাড়িতে সবুজ ব্যাঙের মতোই লাগছে। সবুজ ব্যাঙ, কুণো ব্যাঙ!
রাবিতের কথা শুনে তার সাথে থাকা ছেলে দুটো মুখ টিপে হেসে ফেললো। আর লজ্জায় খুশবুর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ক্লাসের ফ্লোর মাটির না, ইট-পাথরের। ইট-পাথরের ফ্লোরটা যদি তার কথা বুঝতে পারত, তাহলে সে বলতো,
——-তুই ফাঁক হয়ে যা ফ্লোর! আমি তোর ভিতরে গভীরে চলে যেতে চাই। আমি নিষ্ঠুর এ শহরে থাকতে চাই না।
কিন্তু সে বলতে পারছে না। কারণ ফ্লোর তার কোনো কথা শুনতে বা বুঝতে পারে না। সে নিজেও এই রাবিত নামের ছেলেটা কে বুঝতে পারে না। ছেলেটা সব সময় তার সাথে এমন কেন করে! ছেলেটা কি জানে তার শাড়ি পড়ার কারণ সে? এই বাজে ছেলেটার জন্যই সে এত যত্ন করে কুঁচি বেঁধেছে??
——-এই ইঁদুর ছানা! কথা বলছো না কেন? লিপস্টিকের ভারে কি ঠোঁট নড়ছে না??
খুশবু কথাটা শুনে রাবিতের দিকে ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকায়। ছেলেটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। হয়তো আনন্দে। তাকে হেনস্থা করার আনন্দে। খুশবু এক পৃথিবী অভিমান বুকে জমা করে উল্টো দিকে পা বাড়ায়। সে এক মুহুর্তও এই বাজে ছেলেটার সামনে থাকতে চায় না। যদি থাকে, তাহলে সে নিশ্চিত কেঁদে ফেলবে। ছেলেটা তাকে কাঁদিয়েই ছাড়বে।
খুশবু হাঁটছে আর মনে মনে রাবিত কে ঝাড়ি দিচ্ছে। প্রকাশ্যে তো কখনোই সে তাকে বকতে পারবে না, তাই মনে মনেই তার গুষ্টি উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। সামনাসামনি থাকলে তো তার হাত-পা কাঁপে। শুধু কাঁপে না থরথর করে কাঁপে। সে হাঁটা থামিয়ে একবার নিজের দিকে তাকালো। শাড়ির রং টা ঠিক সবুজও না। সবুজের মাঝেই হালকা একটা রঙের মিশ্রণ। এমন রং বুঝি ব্যাঙের হয়!
বাড়ি গেলে তাদের পুকুর থেকে একটা ব্যাঙ ধরে এনে তাকে দেখাবে ব্যাঙের রং কেমন হয়।
শুধু কি দেখাবে? ব্যাঙ টা তার উপর ছেড়েও দেবে। “তখন তিনি বুঝবেন খুশবু কি জিনিস!”
খুশবু যখন দ্বিতীয় বার হাঁটতে শুরু করবে তখন মনে হলো কেউ হাত টেনে ধরেছে। উগ্র মেজাজ নিয়ে পেছন ফিরে যখন রাবিত কে দেখে তখন সে মোমের মতো গলে যায়। রাবিত কি তার জীবনে আগুনের মতো প্রভাব ফেলে?? সে যখনই আগুন হয় তখনই খুশবু মোম হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু ছেলেটা সব সময় কেন আগুন হয়ে থাকবে? একটু পানি হলে কি হয়! ছেলেটা কি জানে এখন যদি তার জায়গায় অন্য কেউ হাত ধরতো তাহলে সে ছেলেটার হাত কেটে রেখে দিত, থাপড়িয়ে গাল ফুটো করে দিত!
রাবিত খুশবুর হাতটা শক্ত করে ধরে পূর্বের অবস্থানের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। খুশবু তার সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে পারছে না। তাকে দৌঁড়াতে হচ্ছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করে উত্তরও পাচ্ছে না। তার উপর শাড়ির কুঁচিগুলো অবাধ্য হয়ে গেছে। খুশবু পথ না পেয়ে তার অন্য হাত দিয়ে রাবিতের হাতে জোরে চিমটি কাটে। রাবিত তৎক্ষণাৎ তার হাত ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে খুশবু সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতেই অবাধ্য শাড়িতে হোঁচট খায়। ফ্লোরে পড়ে গেলে রাবিত তাকে টেনেহিঁচড়ে তোলে রাগী সুরে বলে,
——-অসভ্য মেয়ে! শাড়ি সামলাতে জানো না পড়েছো কেন? সবাই কে দেখাতে হবে তোমার শাড়ি আছে? আর কি কারো শাড়ি নেই??
— সবার শাড়ি না থাক। না থাকলেই ভালো। শুধু আমার একার শাড়ি থাক। শুধু আমি একা আপনার জন্য শাড়ি পড়বো। বুঝেছেন আপনি?
নাহ্। রাবিত বুঝেনি। কারণ তার কান অবধি কথাগুলো পৌঁছায় নি। খুশবু বিড়বিড় করে কথাগুলো বলেছে মাত্র।
—–বকছো তুমি আমাকে? মনে মনে গালি পাড়ছো? তোমার তো দেখছি খুব সাহস বেড়েছে। ক্লাসে টপার বলে সবার সাথে যা-তা ব্যবহার করছো, আবার আমাকেও বকে দিচ্ছো!
— আমি মোটেও সবার সাথে যা-তা ব্যবহার করি না। আমার ব্যবহার অত্যন্ত ভালো এবং মার্জিত।
— আচ্ছা?? তুমি কি ভেবেছো, আমি রোজ ক্লাস এটেন্ড করি না বলে কিছু জানি না?
— নাহ্! আপনি আসলেই কিছু জানেন না। কিছু না, কিছু না, কিচ্ছু না..!!
খুশবু এক নিঃশ্বাসে দ্রুত কথাটা শেষ করে বুঝতে পারলো সে কি বলেছে। রাবিতের দিকে তাকিয়ে দেখে সে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। খুশবুর পুরোনো অসুখটা জেগে উঠেছে। তার মাথা ঝিমঝিম করা শুরু হয়ে গেছে। ছেলেটা এভাবে তাকায় কেন? চোখ থেকে কি তার মায়া ঝরে?? যে মায়ায় খুশবু প্রতিনিয়ত বাজে ভাবে জড়িয়ে পড়ছে!
খুশবুর পা দুটো কাঁপছে, খুব করেই কাঁপছে। মনে হচ্ছে সে এখুণি বেহুঁশ হয়ে নিচে পড়ে যাবে। রক্তারক্তি হয়ে ভয়ংকর অবস্থা হলেও হতে পারে। কিংবা দেখা গেল সে মরে পেত্নী হয়ে গেছে। সে পেত্নী হলে রাবিতকেও ভূত বানিয়ে ছাড়বে। তখন ভূত আর পেত্নী তে মিলে সবাই কে ভয় দেখাবে। ইশশ, কত মজা হত তখন! ভাবতেই খুশবুর মনটা খুশিতে ডগমগ করছে।
কিন্তু খুশবুর খুশিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। রাবিত তার স্বকীয়তা বজায় রেখে, গাম্ভীর্য নিয়ে বললো,
——–আচ্ছা, তাহলে তুমি সব জানো। তাই তো??
খুশবু উত্তর না দিয়ে রাবিতের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। মনে মনে বলে,
—- আমি কিছু না জানলেও আপনার মতো বোকা না। আপনি বড্ড অবুঝ, রাবিত! বড্ড বেশি অবুঝ!
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com