Breaking News

বই প্রেমিক | জান্নাতুল ফেরদাউস


টিভিতে ব‌ইমেলার লাইভ দেখতে দেখতে বড়‌আপু বিরক্ত গলায় বললো, “কি সব হাবিজাবি দেখায়! ‌ব‌ই,ব‌ই,ব‌ই!!! জুয়েলারি,কসমেটিকস এসব‌ও বিক্রি করা উচিত। তাহলে আরো মেয়েরা যাইতো।”

মনুষ্যসমাজের জ্ঞানের পরিধির ক্ষুদ্রতা,জ্ঞান অর্জনে অনীহা এবং শাড়ি,গয়নার প্রতি অত্যাধিক মাত্রায় প্রেমের কারণে নারীরা যে কতটা পিছিয়ে রয়েছে এগুলা চিন্তা করতে করতে বিরক্ত ও শিহরিত হয়ে উঠলাম। আপুকে জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা না করে কঠিন দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি আমার সাথে কথা বলবা না।

আপু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, কেন? আমি কি করলাম?

: তোমার সংস্পর্শে থাকলে আমার‌ও তোমার মতো অবনতি হয়ে যাবে। আমি জ্ঞানের পথের পথিক। আমাদের পথ এক না।

আপু হেসে ফেলে চোখেমুখে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বললো, আহারে জ্ঞানের পথের পথিক। সারাজীবন তো খালি ব‌ই পড়েই গেলি। একটা ব‌ই লিখে দেখাতে পারলি না। জানিস রয়ালের (আমার হবু দুলাভাই) ব‌ই বের হ‌ইছে? আর তুই কি করলি জীবনে?

আমি অবাক হয়ে বললাম, রয়াল ভাইয়ের ব‌ই বের হ‌ইছে? যে ফেসবুকে পোস্ট লেখে, আমি ভাত খায়, আমি ব‌ই পরি.. তার ব‌ই বের হ‌ইছে? কে বের করছে? কি নাম ব‌ইয়ের?

আপু উত্তর না দিয়ে টিভিতে ব‌ইমেলা লাইভের ওপর আরেকবার কুদৃষ্টি হেনে উঠে চলে গেল। আমি রয়াল ভাইকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানলাম। তার ব‌ই সত্যিই বের হ‌ইছে। ব‌ইয়ের নাম ‘হোস্টেলের ডাইল ও বুয়া সংকট’। আমি যখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম এই ব‌ই কে বের করছে তার উত্তরে সে জানালো, ব‌ই বের করছে তার রুমমেট। তার নতুন প্রকাশনী। নাম হচ্ছে, সুরঞ্জনা এবং সুরঞ্জনা প্রকাশনীর এইটাই প্রথম ব‌ই।

আমি সবটা শুনে হতভম্ব হয়ে বসে র‌ইলাম। দিনের আলো নিভে গেল, চাঁদ উঠলো। আমি বিহ্বল হয়ে বসেই র‌ইলাম। আমার ঘোর কাটলো রয়াল ভাইয়ার ফোনে।

-হ্যালো লাবণ্য?

:হু।

-কাল ব‌ইমেলায় আসতে পারবি?

:কিজন্য?

-তোকে আমার ব‌ইটা দেবো তো, অটোগ্রাফসহ এইজন্য।

: পাঠিয়ে দেন।

-আরে না! তা কি করে হয়? ব‌ইমেলায় আসবি। অটোগ্রাফ নিবি,সেলফি তুলবি, ফেসবুকে দিবি তবেই না ব‌ই লেখা সার্থক!

-ভাইয়া সরি! হোস্টেলের ডাইল নামের ব‌ইয়ের সাথে ছবি তুলে আমি ফেসবুকে দিবো না!

: আরে আরে কি বলিস! এইটাই তো ফ্যাশন এখন। অদ্ভুত অদ্ভুত নাম না দিলে ব‌ই বিক্রি হয় না। তাছাড়া শুধু হোস্টেলের ডাইল বলছিস কেন? হোস্টেলের ডাইল এবং বুয়া সংকট। প্রকাশনী সুরঞ্জনা,প্যাভিলিয়ন…

-চুপ করবা?

:তুই ব‌ইমেলায় আসবি কিনা বল!

-আসব না।

ভাইয়া একটা হতাশাভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কেটে দিলো এবং তার পরদিন বিকালে আমি আর আপু ব‌ইমেলার দিকে র‌ওনা হলাম। আমার সাথে যাওয়ার প্রধান কারণ আপুর চিল্লাচিল্লি এবং ভ্যা ভ্যা করে কান্না দিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। আপুর ধারনা এখন যদি আমরা তার ব‌ই না কিনি তাহলে আপুর বিয়ে ভেঙে যাবে। সুতরাং বোনের বিয়ে বাঁচাতে আমাকে হোস্টেলের ডাইল নামক ব‌ইটি,যেটির প্রচ্ছদে চামচে করে পাতলা ডাইলের ছবি,সেটা নিয়ে ছবি তুলতে হবে, ফেসবুকে দিতে হবে। আমার ফ্রেন্ডরা… আমি আর ভাবতেই পারছিনা।

ব‌ইমেলায় গিয়ে দেখি রয়াল ভাইয়া স্টলে বসে বসে হাত চুলকাচ্ছেন। আমাদের দেখেই বললেন,আর ব‌ইলো না এত মশা! শুদ্ধ বাংলায় বলতে হয়, পাঠক নাই বসে বসে মশা মারছেন। কিন্তু সেটা তিনি বলবেন না।

আপু জিজ্ঞেস করলো,কয় কপি বিক্রি হ‌ইছে?

ভাইয়া ইতস্তত করে বললো, এইতো দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রায় শেষ।

দ্বিতীয় মুদ্রণ শেষ জিনিসটা কি আমার আপু জানে না।‌ তা সত্ত্বেও একটা উল্লাসের ভাব তুলে বললো, বলো কি! দ্বিতীয় মুদ্রণ শেষ?

আমি জিজ্ঞেস করলাম,কয় কপি ছিল একেকটা মুদ্রনে?

ভাইয়া আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। আমাকে সাথে নিয়ে হোস্টেলের ডাইল ব‌ইটার ফটোগ্রাফী করলেন,আপুকে সাথে নিয়ে করলেন এবং তৎক্ষণাৎ ফেসবুকে আপডেট দিতে দিতে লিখলেন, “সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে যখন ভক্তরা শুধুমাত্র একটা অটোগ্রাফের জন্য আসে,তখন সত্যিই একজন লেখক হিসেবে নিজেকে নিয়ে গর্ব হয়।” বলাই বাহুল্য,এই ক্যাপশনটা দেবার জন্য বিভিন্ন এঙ্গেলে আমাকে দিয়ে নিজের অটোগ্রাফরত অবস্থার কয়টা ছবি তোলালেন এবং শেষে বিরক্তভরে বললেন, ক্যামেরাটা আনতে কি হ‌ইছিলো?

এরপর আমাকে স্টলে বসিয়ে রেখে ভাইয়া আপুকে নিয়ে বের হলেন শপিং করাতে। আপুর ভালো লাগছেনা কারণ এখানে শাড়ি গয়না কসমেটিকস কিছুই নাই।

চলে যাবার পরপর টিভি চ্যানেলের একজন রিপোর্টারকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি আতঙ্কে অস্থির হলাম। কারণ সে লাইভে বলছে, “সুপ্রিয় দর্শকমন্ডলি,এখন আমরা একজন লেখিকার সাথে কথা বলবো,তার ব‌ইয়ের নাম হোস্টেলের ডাইল এবং বুয়া সংকট…”

আমি বলতে গেছিলাম এটা আমার লেখা না কিন্তু লেখকের নামের দিকে খেয়াল না করেই সে কথা বলতে শুরু করেছে, আপনার নাম?

-জান্নাতুল ফেরদৌস।

: হোস্টেলের ডাইল এবং বুয়া সংকট এটা কি ধরনের লেখা?

-এটা মূলত একটি সামাজিক উপন্যাস। হোস্টেলের পাতলা ডাইল এবং মেসের বুয়া সংকট সমস্যার প্রতি সমাজের সবার দৃষ্টি ফেরাতে এটি লেখা হয়েছে। এটি পড়লে পাঠক জানতে পারবে, কেন মেয়েরা নিষিদ্ধ জানা সত্ত্বেও হোস্টেলে স্টোভ নিয়ে এসে রান্না করে,কেন ছেলেদের পেট খারাপ হয়। এটি মুলত পেট খারাপ সমস্যার দিকে সবার নজর ফেরাবার জন্য‌ই লেখা…

রাতে রয়াল ভাইয়া আমাকে ফোন দিয়ে বললো, এইসব উল্টাপাল্টা কথা কি বলছিস? এটা তো কবিতা সংকলন। সামাজিক উপন্যাস,পেট খারাপের ওষুধ এসব কি কথা?

আমি আবার বাকরুদ্ধ হয়ে বসে র‌ইলাম।‌ রাতের অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে সূর্য উঠলো। আপু এসে চিল্লাতে লাগলো যদি তার বিয়ে ভেঙে যায় তারজন্য দায়ী থাকবো আমি….

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com