গল্প - অমলিন । লিখা - নীল আহমেদ
হাসপাতালে বসে রাবেয়া তম্বিকে বলতে থাকে, “আলভি বাসরঘরে ঢুকে প্রথমেই আমার হাত আর মুখ বেঁধে ফেলে। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় কি করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। মুখ বাধা থাকায় চিৎকার করা সত্ত্বেও গোঙানি ছাড়া অন্য কোন আওয়াজ বের হয় না,” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায় রাবেয়া। তাকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে লক্ষ্য করল তন্বী, মেয়েটা একটু পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে, আর খুব নিচু স্বরে কাঁদছে।
তন্বী রাবেয়াকে চেনে আলভির সাথে তার বিয়ে হবার পর থেকেই। পরিচয়টা খুব বেশি সুখকর নয়, সংগত কারণেই সর্বদা তন্বী রাবেয়াকে এড়িয়ে চলেছে। আজ এই দুঃখের দিনে তার কাছে না এসে উপায় ছিল না। তন্বীর চোখ দিয়েও হালকা জল গড়ায়।
“যদিও আলভিকে আমার অমতে বিয়ে করতে হয়েছিল,” রাবেয়া বলে চলে, “তবু তার চারিত্রিক গুণ সম্পর্কে অনেক ভাল ধারণা ছিল সবসময়। ওর কাছ থেকে অমনটা আশা করিনি। সে হাসতে হাসতে বিছানার নিচ থেকে মদের বোতলের একটা কেস বের করে, তারপর আস্তে আস্তে গ্লাসে ঢেলে চুমুক দিতে শুরু করে। আমি গোঙাতে থাকি আর মাথা নাড়তে থাকি। আলভি কট্টর স্বরে হাসতে থাকে। বলে, ‘সুইটহার্ট, একা গিলব না। তোমাকেও গেলাব।’ আমি ভয়ে পিছিয়ে যেতে চাই, কিন্তু হাত বাঁধা থাকায় খুব একটা সুবিধা করতে পারি না। আলভি হাটু গেড়ে বসে গ্লাসটা আমার মুখের ওপর চেপে ধরে। ‘খাবি না মানে? একশ বার খাবি। তোর চৌদ্দগুষ্টি খাবে।’ আমি ঝরঝর করে কাঁদতে থাকি আর কালচে রংয়ের তরল আমার মুখে বাধা কাপড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আমার গলা ভেজাতে থাকে,” রাবেয়া দম নেয়।
“হঠাৎ করেই সবকিছু ঘটে যাওয়ায় বুঝতে একটু দেরি হয়, তবে দেরিতে হলেও টের পেলাম গলা বেয়ে যাওয়া তরলটা মদ নয়। আমার অবাক হওয়া চোখ দেখেই আলভি খিক খিক করে হেসে ওঠে। এবার আর ক্রুর হাসি নয়, কৌতুকভরা হাসি। ও হাসতে হাসতে বলল, ‘মনে করেছিলে সত্যিই মদ খাচ্ছি? মদ খেলে আম্মা কি আস্ত রাখত আমাকে? সোজা জাহান্নামে পাঠিয়ে দিত।’ আমি কি করব বুঝে উঠতে পারি না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি শুধু। আলভি বলল, ‘বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এরকম হাজারো নারী ঠিক এইভাবে অত্যাচারের শিকার হয়। সমাজ স্বীকৃত বিয়ে বলে তারা বাইরে গিয়ে কাউকে অভিযোগ করতে পারে না।
খুব দুঃখজনক ব্যাপার।’ আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। আলভি আমার হাত আর মুখের বাধন খুলে দিলে আমি প্রাণভরে শ্বাস নেই। আমি বললাম, ‘কেন করলে এমন? কেন?’ কাঁদতে শুরু করলাম। আলভির ভেতর কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। বলল, ‘একটা ডেমোনস্ট্রেশন দিলাম। কত রকম ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে মানুষের জীবনে, তার একটা ছোট্ট নমুনা।’ আলভির ইঙ্গিতটা বুঝতে সমস্যা হয় না, তার সাথে বিয়ে হওয়া নিয়ে আমি অনেক নাটক করেছিলাম। বারংবার অপমান করেছি আলভিকে, শেষমেশ কোথাও ঠাঁই না পেয়ে বাধ্য হয়ে সম্পর্কটা মেনে নিয়েছি। আলভির তার আগাগোড়া সবই জানে। সমস্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার মনমরা চেহারা আর তার সাথে কথা না বলাটা সবকিছু পরিষ্কার করে দিয়েছিল।”
“আলভি তার বিয়ের পোশাক বদলে বিছানার একপাশে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। আমি তখনো অল্প অল্প কাঁপছি। ও আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার কোন চেষ্টাই করল না। শুধু বলল, ‘মা তোমার কাপড়গুলো যত্ন সহাকারে আমার আলমারির অর্ধেক জায়গা জুড়ে সাজিয়ে রেখেছে, পোশাক পাল্টে নিও। বেনারশিতে ঘুম আসবে না।’ বলেই সে নাক ডাকতে শুরু করে। আমার প্রচন্ড রাগ হয়। মাত্র বাবার বাড়ি ছেড়ে আসা একটা মেয়ে বাসরঘরে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, আর বর অঘোরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে! আমি রাগ করে পোশাক ছাড়লাম না। গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লাম।”
“পরদিন সকালে উঠে দেখি আলভি বিছানায় নেই। রাতে হয়তো ভয়ের ঘোরে খেয়াল করা হয়নি, কিন্তু আলভির ঘরটা অসম্ভব রকমের গোছানো। দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিংগুলো আলভি আর তার বাবার করা। জলরঙে আঁকা ছবিগুলো কেমন যেন সম্মোহনের মত, একভাবে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। কম্পিউটার টেবিল ভর্তি আলভি আর তার বন্ধুবান্ধবদের ছবি। ওখানে তোমারও ছবি ছিল তন্বী। সমস্ত ঘরে একনজর বুলিয়ে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি, ঘরটার একচুল এদিক সেদিক করার ক্ষমতা আমার নেই।”
“আলভির প্রতি রাগটা বজায় রাখার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়েই ঘর থেকে বের হলাম। বের হয়ে দেখি এলাহী কান্ড, সকালের নাশতা তৈরী নিয়ে হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে রেখেছে সবাই। আলভির বাবা-মা, আলভি, বড় আপু, শিমু সবাই। কেউ রুটি সেঁকছে, কেউ হালুয়া নাড়ছে, কেউ চা বানাচ্ছে, কেউ গন্ডগোল বাঁধাচ্ছে,” বলতে গিয়ে হেসে ফেলল রাবেয়া, “আমি সামনে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। মা লাগালেন ধমক সবাইকে, ‘এই হতচ্ছাড়ারা, ঘরে নতুন বউ এসেছে, আর তোরা কি শুরু করলি? আর তুমিতো একটু কম করলেও পারো!’ বাবার হাতে একটা রুটি, তার ওপর হালুয়া।
বেচারা অর্ধেক খাওয়া রুটি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা আমার কাছে এসে বললেন, ‘ঘুম হয়েছে মা? চোখ গুলো লাল দেখাচ্ছে। আরেকটু পরে উঠলেই হত, দুই-তিন দিনের ধকল।’ আমি কষ্ট করে একটা হাসি দিতেই গ্যাদগ্যাদ করে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল, রীতিমত হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। কান্নার ঘোরে কী উল্টাপাল্টা বকতে থাকলাম নিজেও জানি না। বড় আপু আর শিমু ভয়ে তাকিয়ে থাকে, মা আমাকে চেয়ারে বসিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে। ঘাবড়ায় না শুধু আলভি, আমার কষ্টে যেন খুব আনন্দ তার। সবকটা দাঁত বের করে মনের আনন্দে রুটি সেঁকতে থাকে।”
“হাসিখুশি পরিবারটার সাথে খুব সহজে মিশে গিয়েছিলাম। আমি মিশে গিয়েছিলাম বললে ভুল হয়, সবাই আমাকে খুব বেশি আপন করে নিয়েছিল, একমাত্র আলভি ছাড়া। শিমু তো রাবেয়াপু বলতে অস্থির, বাবা প্রায়ই আমাকে সামনে বসিয়ে গল্প জুড়ে দিত। মায়ের কারণে বেশি বিপদে পড়তাম, কারণ কি খেলাম, কখন হাসলাম, কখন মন খারাপ হল সব আপ টু ডেট তার নজরে পড়ত। এক আধটু মন খারাপ থাকলেও তাই জোর করেই হাসতে হত। তবু মায়ের চোখে ধরা পড়ে যেতাম।
মা একদিন ডাক দিয়ে বলল, ‘প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে মা। আমাদেরও হয়েছিল। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’ হয়ে যেত। হচ্ছিল না আলভির কারণে। আলভি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করত না কখনোই, বরং আমাকে সে ওএসডি করে রেখেছিল। হয়তো আমি তার অফিসের কাপড়টা গুছিয়ে দিতে চাইতাম, কিংবা ব্যাগটা এগিয়ে দিতে চাইতাম। কখনো ইচ্ছে হত পারফেক্ট বধূর মত টাইয়ের নটটা বেঁধে দেয়ার, সে আমাকে কোনটাই করতে দিত না। এমনকি বেশিরভাগ সময়ই ঘুম থেকে উঠে দেখতাম হয় সে চলে গেছে, নয়তো নাশতার টেবিলে।”
“আলভির সাথে আমার সারাদিনে কোন কথা হত না। যদিওবা কখনো চোখাচোখি হয়ে যেত, তার কঠিন দৃষ্টি দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে যেত। আমার চোখে আকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু তার চোখে ভর্ৎসনা ছাড়া আর কিছুই পাইনি আমি। মা টের পেতেন মাঝে মাঝে, আলভিকে ডাক দিয়ে ঝেড়েও দিতেন। ‘নতুন বউ, একটু খেয়াল খোঁজ রাখতে হয়না? এত কেয়ারলেস হলে কি করে হবে? দেখিসনা মন খারাপ করে থাকে সবসময়?’ আলভি মায়ের কথার কোন উত্তর দিত না। সে আদর্শ স্বামী না হলেও আদর্শ ছেলে ছিল, মায়ের মুখের উপর কঠিন কথাটা সে বলতে পারত না।
আমি মনে মনে অপরাধবোধে ভুগতাম, কারণ নেহালকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি সবসময়, যতদিন তার সত্যিকার চেহারাটা চোখের সামনে না এসেছে ততদিন পর্যন্তই। যেদিন জানলাম নেহালের কাছে আমি টাইম পাস, ক্যাম্পাস আইটেম আর শো-অফ ছাড়া আর কিছু না, সেদিন আমার দুনিয়াটা তছনছ হয়ে গিয়েছিল। আলভির সাথে বিয়ের কথা হবার সময় প্রথম যেদিন আমাদের দেখা হয়, আমি যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছিলাম আলভিকে। আলভি সেদিন একটা টু-শব্দও করেনি, শুধু বলেছিল, ‘তোমার যেটা ইচ্ছে। বিয়ে করতে না চাইলে না করে দাও।’ আমি না করতে পারিনি শেষ পর্যন্ত, বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। নেহাল চলে যাওয়ায় কার্যত আমার ভালবাসার শেষ সত্ত্বাটুকু মরে গিয়েছিল, তাই বিয়ে হওয়া-না হওয়াতে তখন আর কিছু আসে যায় না।”
“আলভি আমার নাড়ি-নক্ষত্র জানত, সে জানত যে আমার ভালবাসা কখনোই সে পাবে না। তাই আমাকে দিন-রাত সে এড়িয়ে চলতে থাকে। একই ছাদের নিচে বাস করেও কি করে এত নিখুঁতভাবে মানুষকে এড়িয়ে চলা যায়, আলভিকে না দেখলে বোঝা যায় না। সে সময়মত বাসায় আসত, ঠিকমত অফিস করত, তবু লোকচক্ষুর আড়ালে আমাকে এড়িয়ে চলত। হয়তো ভালবাসার দৃষ্টিতে না, তবু মানবিক দৃষ্টিতে আমার মনের একটা অংশ চাইত তার মনোযোগ ফিরে পেতে। মা যখন শতকিছু বলেও আলভির কোন ব্যবস্থা করতে পারলেন না, তখন কক্সবাজারের দুটো টিকেট ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘যা, ঘুরে আয়। সাতদিন যেন তোদের চেহারা এই বাসায় না দেখি। সব পেঁচার মত মুখ করে বাড়ি দিয়ে ঘুরবি, তা চলবে না।
সাতদিন পরে যেন হাসিমুখে ফিরিস।’ আলভি বিপদে পড়ে গেল, মায়ের কথার অমতে যেতে পারে না, আবার আমার সাথে সাতদিন থাকাও তার জন্য কষ্টকর। বাসররাতের অনেকদিন পর অবশেষে আলভি আমার সাথে কথা বলতে আসে, ‘তুমি কি যেতে চাও? না চাইলে বলতে পারো, অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।’ আমি বললাম, ‘নিজে যেতে চাইছ না দেখে আমাকে রাজি করাচ্ছ?’ আলভির চেহারা একটু কঠিন হয়, ‘আমার যাওয়া-না যাওয়াতে কিছু আসে যায় না। আমার মতামত মূল্যহীন। তুমি ইম্পরটেন্ট পারসন, তুমি যা বলবে তাই হবে।’ আমার রাগ উঠে গেল, ‘আমি যাব। একশবার যাব, হাজার বার যাব। তোমার সাথে এই ঘরে আটকে থেকে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি সমুদ্রে যাব, গিয়ে দেব এক ঝাঁপ। তারপর আর আমার টিকিটাও খুঁজে পাবে না।’ একনিঃশ্বাসে বলে আমি উল্টো ঘুরে বসে পড়লাম রাগে গজগজ করতে করতে। আলভি শুধু মৃদুস্বরে বলল, ‘তোমার যেটা ইচ্ছে।’ বলেই সে উঠে চলে যায়, আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি।”
“ইতিহাসে আমিই বোধহয় প্রথম নারী, যে এতভাল একটা শ্বশুরালয় পাবার পরও এতটা অসুখী ছিলাম। আমার জীবনে সবকিছু ছিল, শুধু আলভির ভালবাসা ছাড়া। যেই আলভির দিকে জীবনে আমি দ্বিতীয়বার ঘুরে তাকাইনি, সেই আলভির ভালবাসা পাবার জন্য কেন এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম, জানি না। সম্ভবতঃ সবসময় মানুষের মনোযোগ পেয়ে অভ্যাস ছিল তো, আলভির মত সাধারণ একটা ছেলে পাত্তা দিচ্ছে না দেখে বোধহয় আমার আত্মসম্মানবোধে লাগছিল।
যাই হোক, আমরা কক্সবাজার গেলাম। সময়টা এপ্রিল-মে’র মাঝামাঝি। আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। আমাদের মোটেলের রুমটা থেকে সমুদ্র দেখা যেত, গর্জন শোনা যেত। ১২ তলার ওই ঘরটা থেকে উত্তাল ঢেউ দেখেই কাটিয়ে দিতে পারতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিউলি ম্যারিড কাপল হিসেবে বাইরে বেড়াতে না গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাত, আমরা তাই প্রতিদিন সময় করে সমুদ্রসৈকতে যেতাম। পানিতে নামতে খুব ইচ্ছে করত, কিন্তু একা নামার সাহস হত না। আলভি মনের আনন্দে পানিতে দাপাদাপি করত, আর আমি রোদচশমা লাগিয়ে দুঃখভরে দেখতাম।”
“এমনি একদিন সৈকতে থাকতে থাকতেই ঝড় শুরু হল, আলভি পানি থেকে উঠে এসে বলল, ‘চলো যাই, ঝড় আসছে। বৃষ্টিও নামবে।’ আমি বললাম, ‘আসুক।’ আলভি অবাক হয়, ‘আসুক মানে?’ বললাম, ‘বৃষ্টিতে ভিজব, অনেকদিন বৃষ্টিতে ভিজি না। আলভি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে, ভিজো।’ আমি ধরেই নিলাম আলভি আমাকে বসিয়ে রেখে মোটেলে ফিরে যাবে, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে আমার পাশে বসে রইল।”
“এরপর আসল ঝড়, সাথে তুমুল বৃষ্টি। আমি চোখ বন্ধ রেখে দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি। সৈকতের লাইফগার্ডেরা বারবার তাগাদা দিতে থাকে ফেরত যাবার জন্য, আমি পরোয়া করি না। আলভি পাশে দাড়িয়ে অবাক হয়ে আমাকে দেখতে থাকে। কতক্ষণ ওভাবে ভিজলাম জানি না, দুই ঘণ্টা কি তিন ঘণ্টা হবে। পরনের শাড়ি লেপ্টে শরীরের সাথে মিশে গিয়েছিল। ফেরত যাবার সময় হাঁচি শুরু হল, তারপর মাথা ঘোরাতে শুরু করল। মোটেলের নিচে যেতেই হুশ হারিয়ে ফেলেছিলাম, শুধু মনে আছে আলভি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল।”
“আমার হুশ ফিরল পরদিন রাতে, দেখি আলভি কাপড় পানিতে ভিজিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল। আমাকে জাগতে দেখে বলল, ‘সহ্য হয়না যখন, মাতব্বরি করে বৃষ্টিতে ভেজার কি দরকার ছিল?’ এহেন অনুযোগ আমার আর সহ্য হয় না, আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। আলভি আমার ভারি হয়ে আসা মাথাটা তার বুকের মধ্যে নিয়ে চেঁপে ধরে রাখে শক্ত করে, মুহূর্তেই যেন আমার জ্বর অনেকখানি কমে যায়। আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলি, ‘কেন এত কষ্ট দাও? কি মজা পাও কষ্ট দিয়ে?’ আলভি হেসে বলল, ‘কি করবো বলো? ভালবাসি যে!’ দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারানোর আগে আমি অবাক হয়ে অপরিচিত ওই মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকি।”
রাবেয়া চাপা স্বরে কাঁদতে থাকে। তন্বীর মাথায় অজস্র ব্যাপার খেলে যায়, শুরু থেকে শুরু করে শেষ অবধি। অফিসের কাজে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসার পথে আলভিদের বাসটা তুমুল এক দূর্ঘটনার শিকার হয়। বাসের অর্ধেক যাত্রী ইতোমধ্যে মৃত, আরো কয়েকজনের মত আলভির অবস্থা আশঙ্কাজনক। ডাক্তার বলেছেন ৬ ঘণ্টার ভেতর কিছু বলা যাচ্ছে না। হাসপাতালের করিডোরে অস্থির হয়ে বসে আছে আলভির পরিবার, বন্ধুবান্ধব। এক কোণে ঘুপচির মধ্যে রাবেয়ার সাথে বসে আছে তন্বী।
তন্বী রাবেয়ার সুন্দর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়, “তোমাদের বিয়ের পর আলভির সাথে সবসময় কথা হত আমার। ওর প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ, আমি বহুবার চেষ্টা করেছি ওকে তোমার দিকে ফেরানোর, ও শুনতে চাইত না। সমুদ্রসৈকতের ওই ঘটনার পর যখন তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে, আলভি কাঁপতে কাঁপতে আমাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘তন্বী, বিশ্বাস কর্, রাবেয়া যখন ওর আকাশী শাড়িটা পরে আকাশের দিকে মুখ করে ঝড়ো বৃষ্টিতে ভিজছিল, ওকে আবার সেই দেবী দেবী লাগতে শুরু করল, ঠিক আগের মত। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’ ওর ফোন শুনেই বুঝলাম, তোমার প্রতি ওর ভালবাসা কখনো কমেনি।”
রাবেয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, তার কাছে সব খাপছাড়া ঠেকে, “ঠিক আগের মত বলতে?”
মলিন হাসি হাসল তন্বী, “নেহালের চোখে তুমি কতটুকু ভালবাসা দেখেছ আমি জানি না, যা দেখেছ তার কতটুকু সত্যি তা তো নিজেই দেখলে। আফসোস, ভার্সিটি থাকতে তোমার চোখ কখনো আলভির চোখে পড়েনি।”
রাবেয়া বাকরূদ্ধ হয়ে যায়। আইসিইউ থেকে হতদন্ত হয়ে ডাক্তার বেরিয়ে আসে। আলভি এখন বিপদমুক্ত, তবে ও-পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন। আলভির আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব সবাই ও-পজিটিভ রক্ত জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাবেয়া আর তন্বী আস্তে করে হেঁটে আইসিইউ এর জানালার পাশে দাড়ায়। মেডিকেল যন্ত্রপাতিতে বোঝাই হয়ে আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে আলভি। নিশ্চয়ই বাঁচবে সে, বাঁচতে তাকে হবেই, ভাবল রাবেয়া। এখনো যে এক জীবনের অমলিন ভালবাসা ফিরিয়ে দেয়া বাকি……।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com