গল্পঃ অবহেলা ১ম পর্ব
যেদিন আমার বিয়ে হয় ঐ দিন রাতেই আমি ওনাকে বলে দিই যে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। সেদিন উনি চুপ করে সোফায় বসে পরেছিল। একটি বার ও এগিয়ে এসে বিছানায় আমার পাশে বসে নি। এক বার জিজ্ঞেস করেনি তবে কেন তার ঘরে বউ হয়ে আসলাম। আমিই আবার বলেছিলাম ঘুমের মাঝেও আমাকে টাচ কারর চেষ্টা করবেন না।উনি মনে হয় কথাটিতে রেগে যান।উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ান চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। হটাৎ ই বিছানায় হাটু গেড়ে বসে বলতে শুরু করে “ওই আপনি কি মনে করেছেন আমাকে,আমাকে কি মাতাল অভদ্র মনে হয়,ঘুমের মাঝেও যেন আপনাকে না স্পর্শ করি এর মানে কি? আমি কি হিংস্র পশু যে রাতের আধারে আপনার উপরে ঝাঁপিয়ে পরব”?
তারপর আরো কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে নিজের চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকেই বের হয়ে যায়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে বারান্দার দিকে তাকাই দেখি উনি নিরবে বসে আছেন। আর একটু পর পর চোখ মুছতে ব্যস্ত। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে ভাবীর মুখে শুনেছিলাম। ছেলেটা খুব ভালো অবন্তী দেখো তোমাকে অনেক আগলে রাখবে জীবনে অনেক সুখে থাকবে।
তখন ভাবীর কথাটা তেমন আমলে নেই নি। কিন্তু যখন ওনাকে কাঁদতে দেখি তখন ভাবতে থাকি একটা ছেলে মানুষ ও এভাবে কাঁদতে পারে? আমি যতটুকু জানতাম বিয়েটা ওর মায়ের পছন্দেই হয়েছে। হয়তো ভাবছে আমার যে ওকে পছন্দ নয় এটা যদি ওনার মা জানতে পারেন তবে খুবই কষ্ট পাবেন। ওনার মা ক্যান্সার এর সাথে লড়ছিল কবে মারা যায় কোন ঠিক নেই। তাই সব সময় বলতো আমাকে আপনার পছন্দ না এটা ঠিক আছে তবে প্লিজ যত দিন আমার মা বেঁচে আছে আমার মায়ের খেয়াল রাখবেন। কখনো মায়ের অযত্ন করবেন না। কথাটা এতো করুণ ভাবে বলছিল যে আমার নিজের ই কান্না পাচ্ছিল। উনার চোখেও বেদনার জল ঝলমল করছিল। চোখের পানি আড়াল করতে উনি আমার সামনে থেকে চলে যায়। আড়ালে গিয়ে চোখ মুছতে থাকেন।
একদিন উনি তারাতাড়ি বাসায় ফিরে আসেন। আমি তখন আমার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে ফোনে কথা বলতে ছিলাম। উনি এতো তারাতাড়ি দৌড়ে ঘরে ঢুকেন যে আমি আর ফোন টা রাখার ও সুযোগ পাইনি। উনি রুমে ঢুকেই আমার হাত থেকে ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে যায়।তারপর স্কৃনে কল রানিং দেখে ফোনটা এতো জোড়ে আছাড় দেন যে ফোনটা গুড়া হয়ে যায়। তারপর প্রচুর রাগে বলতে শুরু করেন “আপনার বাবা আপনাকে বিনে টাকায় এবাড়িতে পাঠায় নি দেনমোহর এর ২ লাখ টাকা দিতে হয়েছে,বিয়ের গয়না আর অন্যন্ন খরচ বাবদ প্রায় ৪-৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ১০ বছরের সব জমানো ভালোবাসা আর টাকা দিয়ে তারপর আপনাকে এই বাড়িতে এনেছিলাম। এর কোন শুকরিয়া আপনি আদায় করেছেন হুম,কি চেয়েছিলাম আপনার কাছে মোহরানার টাকা পরিশোধ করার পর আপনার উপরে আমার সম্পূর্ণ হক ছিল তবুও এক মুহুর্তের জন্য আপনাকে স্পর্শ করিনি।বিয়ে করে আনার পর এ বাড়ির ছোট বড় কাজ গুলো করাও আপনার দ্বায়িত্ব ছিল কিন্তু তাও কোন দিন আপনাকে বলিনি। শুধু বলেছিলাম মাকে একটু দেখে রাখবেন। আর মা ১ ঘন্টা আগে তার খারাপ লাগার কথা বলেছে আমাকে ফোন দিয়ে। আমি অফিস থেকে চলে আসছি আর আপনি একটু পাশের রুমে গিয়েও দেখতে পারেন নি আমার মা কেমন আছে।আর দেখতেও হবে না আপনাকে। দেনমোহর এর অর্ধেক টাকা ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাবেন এখান থেকে আপনাকে আমার প্রয়োজন নেই”।
তারপর হনহন করে চলে যায়। আমি কখনো এতো কষ্ট পাইনি ওনার কথায় যতোটা কষ্ট পাই। আসলেই তো এই বাড়িতে তো আমার হাজার টা দ্বায়িত্ব আর আমি কিনা ওনার একটা আবদার পূরণ করতে পারলাম না। আর কি যেন বলেছিল ১০ টা বছরের জমানো ভালোবাসা। মানে কি আসলেই তাই? যেদিন থেকে যৌবনে প্রদার্পন করেন তখন থেকেই যে ব্যক্তি অনাগত স্ত্রীকে ভালোবাসাতে পারেন,আমি কিনা তাকে একটি বারের জন্য ও ভালোবাসতে পারিনি। তার একটা আবদার ও পূরন করতে পারিনি। ধপাস করে ফ্লোরে বসে পরি আমার চোখ দিয়ে তখন অবিরাম পানি ঝরছিল এই প্রথম মন ভরে কান্না করি। হটাৎ করে মাইক্রোবাস এর দরজা টানার আওয়াজে আমার হুস ফিরে। তারাতাড়ি ঘর থেকে বের হই। দেখি উঠানে একটা মাইক্রোবাস দাড়িয়ে আছে। আর উনি আম্মা(শাশুড়ী মা) কে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। কি হয়েছে দেখার জন্য দৌড়ে যাই দেখি আমার শাশুড়ীর জ্ঞান নেই। বুঝতে বাকি রইল না যে উনি অসুস্থ হয়ে পরেছেন। আমি উনাকে কেবল “আমিও যাব” কথাটা বলই দৌড়ে রুমে চলে আসি। তারাতাড়ি বোরকা টা পরে রুম থেকে বের হই। আম্মাকে গাড়ির পিছনের বড় সিট টাতে লম্বা করে শোয়ানো হয়েছে আর মাথাটা আমার স্বামীর উরুর(রানের) উপরে রাখা। আমি ও গাড়িতে উঠে পরি। গিয়ে ওনার পাশে বসে বলি “আপনি সামনে চলে যান আম্মার মাথাটা আমার কোলে দিন”।
উনি কোন কিছু না বলে আমার দিকে রক্ত চোখে তাকান। উনার চাওয়াতে নিষেধ স্পষ্ট। বাধ্য হয়ে আমি পিছনের সিটে গিয়ে বসে পরি। আম্মাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকানো হয়। আর উনি পুরো বারান্দা জুড়ে পায়চারি করছেন। আমি বসে থাকতে পারছিনা কেননা উনি হাটতেছেন এই অবস্থা আমি বসে বসে জিরাই তবে উনি হয়ত আবার ও কষ্ট পাবেন। আমি এগিয়ে গিয়ে উনাকে বসতে বলি উনি বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকান আমি ভয়ে আর কিছুই বলিনি। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে থাকি। উনি কিছুক্ষন পরে লোহার লম্বা চেয়ারটাতে গিয়ে বসেন।আমিও ওনার পাশে গিয়ে বসি হাতটা এগিয়ে ওনার কাঁধে রাখতে মন চাইছে কিন্তু ভয়ে এগোতে পারছিলাম না। মন চাইছিল ওনার বুকে মাথা রেখে কতোক্ষন কান্না করি হয়তো উনি কিছু টা ভরসা পাবেন, আর আমার একটু ভালো লাগবে কিন্তু অতটা সাহস আমার তখন নেই।
একটু পর ডাক্তার রুম থেকে গোমড়া মুখে বেড়িয়ে আসে। আমার স্বামী দৌড়ে ওনার কাছে যান। অতপর ডাক্তার যা বলল তা শুনার জন্য আমরা কেউ তৈরি ছিলাম না।
(চলবে…)
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com