Breaking News

গল্প: বৈশাখের উপহার

নববর্ষ উপলক্ষে ভালোবাসার মানুষটিকে ভালো কিছু উপহার দিবে ইচ্ছেটা ঘুরপাক খাচ্ছে মাহিনের মাথায়। মাহিনের খুব ইচ্ছে মিথিলাকে সে নীল শাড়ী আর লাল চুড়ি পরিহিতা অবস্থায় দেখবে। মাহিন বেকার হওয়ায় তার কাছে তেমন টাকাকড়ি নেই যে সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে একটি নিল শাড়ী কিনে দিবে। কারণ, শাড়ীর যে তুলনামূলক অনেক দাম! আর মাহিন তো নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। দু'বেলা ডাউলভাত খেতেই হিমশিম লেগে যায় পরিবারে।

প্রতিমাসের টিউশনি আর রিক্সা ভাড়া থেকে অল্পস্বল্প জমিয়ে রাখতে রাখতে মানিব্যাগটাকে একটু সবল করে তুলেছে মাহিন। সবমিলিয়ে ৮৫০ টাকা। বৈশাখের আগমনের মাত্র দুইদিন বাকী। এই অল্প টাকায় শাড়ী কেনা সম্ভব নয় তা মাহিন খুব ভালো করেই জানে।

ইচ্ছেটা অপূর্ণ থেকে যাবে এই ভেবে মন খারাপ হয়ে যায় মাহিনের। পরক্ষণেই কি যেন ভেবে মিটিমিটি হেসে নিজে নিজে বলে উঠে- "ইচ্ছেটা নাহয় কল্পবক্সে থাকুক জমা। নিল শাড়ীর বদলে নিল একটি জামা দিলেই তো পারি আপাতত।" মাহিন হয়তো ভাবছে আজীবন তো আর এরকম অভাবে থাকবো না, অভাব দূর হয়ে একদিন স্বচ্ছলতা আসবে নিশ্চয়।

রাস্তার ধারে একটি বেঞ্চিতে বসে ৮৫০ টাকাকে আবারো গুনছে মাহিন, পরে যেন বিপদে পড়তে না হয় এই ভেবে। মাহিন লক্ষ করলো একটি ভদ্রলোক সামান্য দূর থেকে মাহিনকে দেখছে। অস্বস্তি লাগছে মাহিনের। সে হাটা শুরু করলো কোনো এক কাপড় দোকানের উদ্দেশ্যে।

মাহিন লক্ষ করলো ভদ্রলোকটি তার পিছু নিয়েছে। মাহিন অবাক হয় লোকটির কর্মকান্ড দেখে। "লোকটি এই ৮৫০ টাকার লোভে পিছু নিলো না তো! ধুররর এই অল্পকটা টাকার জন্য কেউই পিছু নেবেনা।" মাহিন এসব ভাবছে আর হাটছে। লোকটা মাহিনের পিছু-পিছুই হেটে যাচ্ছে।

মাহিন শপিংমলে ঢুকতে যাবে তখনি লক্ষ করলো দুইটা পিচ্চি রাস্তার ধারে বসে কান্না করছে। একটা সাত কিংবা আট বছরের একটা ছেলে। ছেলেটার পাশে বসিয়ে রেখেছে চার/পাঁচ বছরের একটি পিচ্চি মেয়েকে। মাহিন বাচ্চাদুটোর কাছে যেতেই লক্ষ করলো ছেলেটার বা'হাতের কিছু অংশ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। মাহিন জিজ্ঞেস করে- "এই পিচ্চি তোর হাতে কি হয়েছে রে?"
- দাদা, পাঁচটা টেহা দেন। (পিচ্চি)
- তার আগে বল হাতে কি হয়েছে? (মাহিন)
- ছুডো বইনের বৈশাখী কাপড় কিনার লাইগা মালিকের কাছে ২০০ টেহা চাইছিলাম। কিন্তু টেহা না দিয়া আমার হাতে গরম খুন্তি লাগাই দিছে। (বলে কান্না করতে থাকে ছেলেটি)
- তোর মালিক তোকে দিয়ে কি কাজ করায়?
- ভিক্ষা করায়। বলছে আজ যদি ৩০০ টেহা ভিক্ষা করতে পারি তাইলে ২০০ টেহা দিব কাপড় কিনার লাইগা। না পারলে রাইতের খাওয়া নাকি বন্ধ।
ছেলেটার কথা শুনে ছদ্মবেশী মালিকের প্রতি খুব ঘৃণা জন্মায় মাহিনের মনে। সামান্য ক'টা টাকার জন্য খুন্তি দিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলা! এগুলা মানুষ নাকি পিশাচ?

"আয় আমার সাথে।"
বলে বাচ্চা মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ছেলেটাকে একহাতে ধরে শপিংমলের ভেতর ঢুকে পড়ে মাহিন। অল্প টাকার মধ্যে নিজের সাধ্যমতো দুজনকে বৈশাখ এর কাপড় কিনে দেয়। কাপড় পেয়ে বাচ্চাদুটো অনেক খুশি। চার/পাঁচ বছরের পিচ্চি মেয়েটার মুখের হাসি দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র সে কোনো এক বিশাল রাজ্য জয় করে এসেছে। বাচ্চাদুটোকে বাহিরের দোকান থেকে অল্পকিছু খাইয়ে দিয়ে ওদের থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার ধারে আসে মাহিন। ভাবতে থাকে- "এইবার আর কেনা হলো না কিছু। যাই হোক ভালোবাসা তো থাকবেই। পরে নাহয় দিবো, ইচ্ছেগুলো থাকুক জমা।"

মানিব্যাগ তদন্ত করে দেখতে পেলো মানিব্যাগে এখনো ত্রিশ টাকা আছে। মাহিন এক প্রশান্তির হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠে- "যাক, রিক্সায় করে বাসায় ফেরা যাবে এবার।"
মাহিন তার কাধে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে যায়। পিছু ফিরে দেখে তাকে অনুসরণ করা সেই লোকটি। মাহিন এবার সাহস করে বলেই ফেলে- "দেখুন আমার কাছে ত্রিশ টাকা বাদে এক টাকাও নেই। এটা নিবেন?"

মাহিনের মুখে এমন কথা শুনে ভদ্রলোকটি জোড়গলায় হেসে উঠে, মাহিন আবারো চমকে যায়।
- আচ্ছা, তোমার টাকা গুনার ধরণ দেখে আমি আন্দাজ করেছিলাম তুমি জরুরি কিছু কাজ করবে এই টাকাগুলো দিয়ে। তারপর ওই বাচ্চাগুলোকে সাহায্য করলে। তুমি কি টাকাগুলো দিয়ে অন্য কিছু করতে চেয়েছিলে? (ভদ্রলোকটি)
- হ্যাঁ। ভালোবাসার মানুষটির জন্য একটি নিল জামা কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাচ্চাগুলোকে সাহায্য করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। (মাহিন)
- তুমি নিল জামা কিনতে চেয়েছিলে, আর আমি যদি তোমাকে একটু নিল শাড়ী উপহার দেই তাহলে কি সেটা নিবে?
- তা কি করে হয়! আপনি আমাকে কেন উপহার দিবেন? (আমতাআমতা করে মাহিন)
- "তুমি বাচ্চাগুলোকে উপহার দিলে আর আমি তোমাকে দিবো। এটাই হবে ব্যস!"
কথাটি বলেই ভদ্রলোকটি কাকে যেন ফোন করে।
অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই একটি গাড়ী এসে থামে ভদ্রলোকটির পাশে।
মাহিনের হাতে একটি নিল শাড়ী আর একটি হলুদ পাঞ্জাবী দিয়ে লোকটি বলে- "এগুলো আমার তরফ থেকে তোমার আর তোমার ভালোবাসার মানুষের জন্য ছোট্ট উপহার। আশাকরি গ্রহণ করবে।"
ভদ্রলোকের কথায় মুগ্ধ হয়ে মাহিন উপহারগুলো হাতে নেয়। ভদ্রলোক একটি বিজয়ী হাসি দিয়ে গাড়ীতে বসে পড়ে আর জানালা দিয়ে বলে উঠে- " তুমি খুব উদার মনের মানুষ। ভালো লাগলো এমন কারোর দেখা পেয়ে। আল্লাহ হাফেজ।"

বলতেই গাড়ীটা চলতে থাকে মাহিনের অজানা কোনো প্রান্তে, হয়তো ভদ্রলোকটির গন্তব্যে।
আশেপাশের লোকদের মধ্যে কানাকানি হতে দেখে মাহিন ভদ্রলোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে তারা বলে- " ইনি একজন প্রতাপশালী লোক, টাকা-পয়সার অভাব নেই। মাঝেমধ্যেই আসেন কাউকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। তবে একদিনে মাত্র একজনকে নিজ হাতে সাহায্য করে থাকেন। "
মাহিন আর কিছু না বলে হাটতে শুরু করে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। মাহিন খুব খুশি ভালোবাসার মানুষটিকে নিল শাড়ীতে দেখবে বলে। বাচ্চাদুটো খুশি নতুন কাপড় পেয়ে। ভদ্রলোকটিও খুশি কাউকে নিজ হাতে সাহায্য করতে পেরেছে বলে। তাদের খুশিতে হয়তো বিধাতাও খুব খুশি। সবকিছুতে পরিপূর্ণ হোক আগন্তুক মাস "বৈশাখ।"

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com