গল্পঃ প্রগতির প্রত্যাশা | লেখকঃ নীল মির্জা
শ্বাশুরি আম্মা সকাল হতেই বললো।
“ কী ব্যাপার জামাই? তুমি নাকি আমার মেয়েকে জয়া আহসানের সাথে তুলনা করছো? সে তো কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। ”
আমি চোখ ক্যাঁচলিয়ে উঠে বসলাম।
“ বলেছিলাম? ”
কড়া গলায় জবাব দিলেন।
“ আমার মেয়ে যেহেতু বলেছে তুমি বলেছো তারমানে তুমি অবশ্যই বলেছো! ”
“ কিজানি, ঘুমের ঘোরে হয়তো বলেছিলাম। জয়া আহসানের মতো বলাতে কান্না করার কী আছে আম্মা? ”
“ চুপ করো তুমি। আমার মেয়ে কী বুড়ি হয়ে গেছে? কী বুঝাতে চাও তুমি? ”
ভাবসাব দেখে বুঝায় যাচ্ছে মহিলা খুব রেগে গেছেন!
“ আপনার মেয়ে কোথায়? ”
শ্বাশুরি আম্মা কথার জবাব না দিয়ে চলে গেলেন! তাঁর খুকোমনি কান্নার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। বের হয়ে বাম দিকের বারান্দায় গেলাম।
“ তরী, আমার সোনা বৌটা কাঁদছো কেন? ”
নাক মুখের পানি এক করে জবাব দিলো।
“ আমি বুড়ি হয়ে গেছি। সারাদিন মেকাপ করে ফর্সা থাকি। আমি যা ইচ্ছা করবো। আপনার কী? ”
“ কে বলেছে এসব? তাঁর নামটা বলো। শালার সাহস কত বড়? আমার বৌকে বুড়ি বলে। ”
“ ঢং করবেন না। আপনিই রাতে আমাকে জয়া আহসানের মতো বলছেন। ”
“ বলেছিলাম? ”
“ হ্যাঁ। ”
“ বললে ভুল বলেছিলাম। তুমি তো ঐশীরিয়ার মতো। ”
“ তার মানে আমি জয়ার থেকেও বুড়ি? ”
ওর কাছে গিয়ে বললাম।
“ একটা সিগারেট আনো না। কাল রাত থেকে একটাও খাইনি। ”
“ আমি আছি আমার জ্বালায় আর আপনি আছেন সিগারেট নিয়ে? ”
এই বলে সে চলে গেলো। এই মেয়েটার চোখে পানি আসলে আমার ভালোই লাগে। পুরনো হিন্দি গজলের মতো শোনায়।
দুই দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি শ্বশুরবাড়ি। প্রথম দিনেই একটা গ্যাঞ্জাম লেগে গেলো! মেয়েটা রাগ করেছে তো করেছে! আমি নাকি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওকে বয়স্ক বলেছি!
এরকম করে দুটো দিন কেটেই গেলো। বাড়িতে আসলাম, তবুও মেয়েটা স্বাভাবিক হচ্ছে না! চুপ করে বসে থাকে। কথাবার্তা বলে না। এভাবে আর ভালো লাগছে না।
তিন দিন ধরে হাসপাতালে যাচ্ছে না। সে আবার মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ। বিছানায় শুতে গেলাম। ও খুব কষ্টস্বরে বললো।
“ আমাকে হয়তো আপনার এখন আগের মতো ভালো লাগে না। পড়ালেখা শেষ করে বিয়েটা করতে হয়তো একটু দেরিই হয়ে গেছে। আমি সুন্দরী নই। শরীরের মাংসপেশিগুলোও হয়তো যুবতী মেয়েদের মতো না। একটু ঢিলেঢালাই হয়ে গেছে। কিন্তু হাসপাতালের সময়টুকু বাদে। যতটুকু সময় আপনার সেবায় নিয়জিত থাকি। এর চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণও যদি জিম করতাম। আমিও ফিট থাকতাম জয়া আহসানের মতো বা বিশ্ব সুন্দরী ঐশীরিয়ার মতো। আর সারাদিন মেকাপের উপরে থাকলে আমাকেও অপরূপ দেখাতো। ঘুমান, আলো নিভিয়ে দিচ্ছি। ”
তরীর চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো গাল বেয়ে। খাটের একপাশে হাত পা মুড়িয়ে শুয়ে রইলো।
আমি জেগে থাকলাম। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকলাম। শেষ রাতে ঘুমিয়েও আজকে তরীর আগে ঘুম থেকে উঠলাম। অনেকক্ষণ পরে তরী চোখ খুললো। শোবার রুমে অপরিচিত দুজন নারীকে দেখে ইতস্তবোধ করলো!
আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
“ কী ব্যাপার? উনারা কারা? ”
আমি পেপারের কিছু কাটিং তরীর হাতে দিয়ে বললাম।
“ ইনি জয়া আহসান। হবিগঞ্জে থাকেন। পেশায় একজন ডাক্তার। ইনি ওখানকার মামনি জয়া নামেই বেশ পরিচিত। মায়ের মমতা আর সবার চোখের মনি। ইনি ডাক্তারি শেষ করার পর থেকে সেবার বিনিময়ে একটা পয়সাও কারো কাছ থেকে নেননি। বিনা পয়সায় দশ বছর যাবৎ চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন! টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় উনার বাবা মারা যান। সেদিন থেকেই প্রতীক্ষা করেছিলেন ডাক্তার হয়ে সবাইকে বিনা পয়সায় সেবা দিয়ে যাবেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত! পেপারের টুকরোগুলো পড়ো, বিস্তারিত জানতে পারবে। তুমিও তো কম নও তরী! কোনোদিন তো দেখিনি কারো কাছ থেকে চিকিৎসার বিনিময়ে টাকা নিয়েছো! আমি জানি তোমার বা আমাদের টাকার দরকার আছে! আমি যা আয় করি তা দিয়ে দুজনের বেশ ভালো ভাবেই চলে যায়! কিন্তু তুমি যদি টাকা নিতে। আমাদের হয়তো ভাড়া বাড়িতে থাকতে হতো না। নিজস্ব ফ্ল্যাট থাকতো! আমি তোমাকে জয়া আহসানের মতো বলে ভুল তো করিনি না? ”
তরী কী বলবে বুঝতে পারছে না! স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখও নড়ছে না!
“ আর বাকি থাকলেন ঐশীরিয়া রানী। জয়া আহসানের কাছ থেকে তো হাসপাতালের একটি চেম্বার থেকে মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসা নেয়। আর ঐশীরিয়া রানীর পুরো হাসপাতাল থেকেই মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসা নেয়! মানুষের জন্য উনি উনার মায়ের নামে একটা হাসপাতাল দিয়েছেন। যেখান থেকে সেবা পেতে এক পয়সাও খরচ করতে হয় না! বছরের পর বছর ধরে এমনটা হয়ে আসছে। ভাবতে পারো? আমি জানি তোমারও এমন ইচ্ছে আছে। শুধু সামার্থ আর সময়ের ব্যাপার। তোমার ভেতর বাহির আমি ছাড়া আর কে ভালো জানে? ”
তরী কোনো কথাই বলছে না।
ভদ্র মহিলা দুজন যাবার আগে বলে গেলেন।
“ আমরা আসাতে আপনার ক্ষতি হয়নি তো? ”
বড় মনের মানুষেরা যেমন বলে থাকে। অথচ নিজেরাই না কত কষ্ট করে রাতভর ভ্রমণ করে এসেছেন!
সকাল দশটা বেজে গেছে। বেরোতে হবে।
“ ঐ। ”
তরীর ডাক উপেক্ষা করে গোসলখানায় ঢুকার চেষ্টা করলাম। তরী দিলো না। পেছন থেকে টি শার্টে টান দিয়ে বললো।
“ বিয়ের তিনটে বছর হয়ে গেছে। মা হওয়ার খুব ইচ্ছে জাগেনি। কিন্তু আজকে আপনাকে খুব বাবা বানাতে ইচ্ছে করছে! ”
“ এরকম ডায়লগ জয়া আহসান কোনো বাংলা সিনেমায় দিতে দেখিনি তো। ঐশীরিয়ার হিন্দি সিনেমাতেও না! এটা কার ডায়লগ? ”
তরী নাকমুখ এক করে বললো।
“ দ্যা গ্রেট তরীর ডায়লগ হিহিহি ”
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com