গল্পঃ পাগলির লুকায়িত ভালবাসা
পরন্ত বিকেলে জলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে টোঙ দোকানের সামনের দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধুসর ধুয়ায় চারদিক অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছি।প্রতি টানে হয়তবা এক একটি করে কষ্ট পুড়িয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম।
এভাবে আনমনে দাড়িয়ে আছি,কারন আমার ঘরে ফিরার কোন পিছুটান নেই।যেই মানুষটিকে জন্য ঘরে ফিরব!!মানে আমার অর্ধাগ্নী সেই মানুষটি আজ দুই মাস যাবত আমাকে রেখে বাবার বাড়ি চলে গেছে।তার কারন হল,তিন মাস হল আমার নাম বেকারদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।আপনাদের হয়ত মাঝের এক মাসের হিসাব গড়মিল লাগছে !চলুন এই মাসের হিসাবের মাধ্যমে পুরা গল্পটি আপনাদের সামনে তুলে ধরি,,,
আমি ফয়সাল,ডিপ্লোমা পাশ করার পর ছোটখাটো একটা চাকরিরত অবস্থায় যে,বিবাহখানা করেছিলাম।সেই বউয়ের নাম হচ্ছে ফারিহা।যিনি আমার গৃহত্যাগ করিয়া বাপের গৃহে এখন অবস্থানরত।
ছোটখাটো যে চাকরি করতাম তাও বেশি দিন কপালে সইল না।তবে চাকরি চলে যাওয়ার কারন একটাই,কলিকদের সাথে মিলে কম্পানির মাল চুরি করে বিক্রি করতে অশিকার করা।তাই মাল চুরি হয় ঠিকিই,কিন্ত কলিকদের নিপুন দক্ষতায় সম্পর্ন দোষটা আমার ঘাড়ে দিয়ে আমাকে চাকরিচুত করা হয়।তারপর শুর হয় বেচে থাকার নতুন সংগ্রাম।নিজের পছন্দের বাইক,ঘড়ি,এমনকি চাঁদনি রাতে ফারিহার কোলে মাথা রেখে যে, গিটারটা বাজিয়ে সারারাত দুজনে জোসনার স্নান করতাম সেই গিটারটাও বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়েছিল।
এর মধ্যে হাজারো দুয়ারে করা নাড়ছি একটি চাকরির জন্য কিন্ত কোন লাভ হয় নাই।
এভাবেই একটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছিল আমার আর ফারিহার।কিন্ত হঠাত করে ফারিহা আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যেতে চাইল।আমিও বাধা দিতে পারিনি কারন আমার সেই ক্ষমতা ছিল না।তারপর থেকে আমার এই একলা পথ চলা।
একলা পথ চলা বললে ভুল হবে,কারন ফারিহাকে আমি ঠিক বুজতে পারছিলাম না,কারন তখন প্রতিদিনই পাগলিটা গভির রাতে আমাকে ফোন করে,জিজ্ঞাস করে আমি খেয়েছি কিনা?কি করছি?আর বুকের মধ্যে জমানো হাজারো বোবা কান্না লুকিয়ে আমার সাথে হেসে কথা বলার চেষ্টা করে।কিন্ত আমি সবিই বুজি,,মেয়েটা কাঁদছে।
মাঝে মাঝে ত মেয়েটা কথা বলতে বলতে না বলেই ফোন কেটে দেয়,,কান্না লুকিয়ে রাখতে না পেরে,এই কাজ করে মেয়েটি।কিন্ত আমাকে পরে ফোন করে মিথ্যা কথা বলে যে,বাবা এসে পরেছিল।কিন্ত আমি সবিই বুজি।কিন্ত একটা প্রশ্নর উওর কোন ভাবেই মেলাতে পারতাম না!!তবে কেন পাগলিটা আমাকে একা রেখে চলে গেল!!শুধু এখানেই শেষ না,বাবার থেকে যে হাত খরচের টাকাটা পায়,তা খরচ না করে এক একটা টাকা জমিয়ে আমার ফোনে বিকাশ করে মেয়েটি।সেই টাকা দিয়েই চাকরি না থাকা সত্ত্বেও আমি জীবন চালাচ্ছি।
প্রথমে আমি টাকা নিতে চাইতাম না,কিন্ত মেয়েটা বলে কিনা!!এই টাকাটা নাকি আমার কাছে জমা করছে,আমার চাকরি হলে সুদে আসলে বুজে নিবে।আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম,সুদ হিসাবে কি দিতে হবে।পাগলিটা বলে কিনা নুপুর কিনে দিতে হবে।নিকোটিনের ধুয়া উরাতে উরাতে এসব কথা ভাবছি, হঠাত পিছন থেকে কেউ কলার ধরে টান দিল,ঘুরে তাকিয়ে দেখি ফারিহা,এক রাশ ক্রোধ আর অগ্নি চক্ষু নিয়ে আমাকে বলতে লাগল,কুত্তা তুই সিগারেট খাচ্ছিস কেন?আমি এত কষ্ট করে বাবা,মা,এমনকি ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে ভিক্ষারির মত টাকা নিয়ে সেই টাকা তোকে দেই।আর তুই কিনা সেই টাকা দিয়ে সিগারেট খাচ্ছিস! তোকে দেখে ত মনে হচ্ছে!!আমাকে ছাড়া খুব ভাল আছিস।ফারিহা কথা গুলো একনাগাড়ে বলে কাঁদতে কাদতে বলে হনহন করে চলে গেল।
আর আমি বোকার মত দারিয়ে রইলাম।হতাশা আর রাস্তায় ফারিহার এমন আচরনে মন খারাপ করে নদির পার চলে আসলাম।মনে মনে ভাবতে লাগলাম,অভাব গভির ভালবসাকেও এক নিমিষে শেষ করে দিতে পারে।কত মধুর ছিল আমাদের সেই সোনালি দিন গুলো,ফারিহার সাথে প্রথম পরিচয় ইন্টার ১ম পর্বের পরীক্ষার সময়।কলেজ পরা সময়ে পার্ট টাইম জব আর টিউশনি করে সংসার ও নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতাম।তাই এক্সম বাদে কলেজ যেতাম না।একদিন এক্সম এর দেড়ি হয়ে যাচ্ছিল,তাই হেলিকাপ্টারের খালাত ভাইয়ের গতিতে দৌড়ে কলেজ যাচ্ছিলাম,হঠাত ধারাম করে কার সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে গেলাম।তাকিয়ে দেখি একটা অপ্সরী।
মেয়েটা কিছু বলার আগেই আমি বললাম,কি মেডাম সুন্দর ছেলে দেখলে বুজি মাথা ঠিক থাকে না!!যেচে পরে ধাক্কা খান,বাড়িতে বাপ,ভাই নাই?যেখানে মেয়েটার আমাকে এসব কথা বলবে সেখানে আমার মুখে এমন কথা শুনে মেয়েটা বাংলার ছয়ের আপন বড় ভাই নয় এর মত মুখ করে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি মেয়েটাকে কোন কথা বলতে না দিয়ে,বিনা তৈল,মবিলে চলা পা খানাকে সজোরে চালিয়ে এক্সম দিতে চলে আসলাম।কিন্ত প্রশ্ন দেখে হিসু পেয়ে গেল।(আমার মত বিলিয়ার্ড ছাত্ররা অবশ্যই এই বিষয়ে একমত হবেন যে,যেদিন প্রশ্ন কঠিন হয় সেদিন টয়লেটে যাওয়ার পরিমান বেড়ে যায়)।কোন উপায় অন্ত না পেয়ে সামনে বসে থাকা রমণীকে কলমের আলত গুতায় শুয়ে দিলাম,রমণী পিছু ফিরে তাকাতেই চোখ দুটো লাটিমের মত ঘুরতে লাগিল,কারন মেয়েটি হল এক্সমে আসার আগে যাহার সাথে ধাক্কা খাইয়েছিলাম তিনি।আমার দিকে ডাইনি মার্কা হাসি দিয়ে বলে উঠল,আপনার ঘরে কি মা,বোন নাই?এক্সম হলে মেয়েদের গুঁতাগুঁতি করছেন?
আমিঃমা,বোন ত ঘরে আছে।এক্সম হলে ত নাই!!(দুষ্টু হাসি দিয়ে)
মেয়েঃ(মেয়েটা মুশকি হাসি দিয়ে)তাহলে,এক্সমের আগে পড়ে আসতে পারেন না!!
আমিঃএসব কি বলছেন!!এক্সম দিতে আসার আগে আপনার সাথে পড়ে যাওয়ার কারনে কোমড়ের তিনটা হার ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর সাথে লুটুপুটু খেলছে।এরপরো পড়া হয়নি বুজি!!(মন ভুলানো হাসি দিয়ে)
মেয়েঃঅহ তাই!নেও দেখ।(মুশকি হাসি দিয়ে)তবে খাতা আমাকে না কিন্ত!
আমিঃএহ!!যেইনা চেহারা নাম রাখছে আমের ফুফাতো বোন পেয়ারা(মনে মনে)
এরপর এক্সম শেষ করে,বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম,মেয়েটি আমাকে দেখে কাছে আসতেই আমি একটু ভাব নিয়ে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,থাক থাক ধন্যবাদ দিতে হবে না।এক্সম হলে সবাই সবাই কে দেখায়।আমিও তাই আপনাকে দেখাইছি!কিন্ত আগামী এক্সম গুলোতে পড়ে আসবেন কিন্ত!!মেয়েটা আমার কথা শুনে, হেলিক্টারের পিসতুতো বোন ফ্যানের মত চোখ ঘুরিয়ে অবাক নয়নে আমার মত অবলা ছেলের দিকে ইফটিজিং নজরে তাকিয়ে রইল,,,
তার কিছুক্ষণ পর গিরগিটির মত চেহারা বদলায়ে রাগি লুক করে বলিয়া উঠিল,,
মেয়েঃওOoo আপনি আমাকে দেখাইছেন বুজি!!
আমিঃ হুম,,,ভুলে গেলেন নাকি!আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা আমার দিকে বদ মতলবে দৌড় দিল।আমিও নিজের মান সম্মান নামক ইজ্জত বাচাইতে দৌড় লাগালাম।এভাবেই শুর হয়ে গেল আমাদের দৌড়াদৌড়ি।সেখান বন্ধুত্ব,® ওখান থেকে ব্যাক্টেরিয়াম জনিতরোগ লাভেরিয়া,অত:পর শুধু বিয়া,,
নদির পার বসে ফারিহার সাথে পরিচয়ের এইসব দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম,কখন যে রাত ১০ বেজে গেছে খেয়াল করিনি,,তাই তাড়াতাড়ি করে বাসার দিকে রওনা দিলাম।দরজা খুলে ভিতরে দুই পা না দিতেই উল্টা দিকে দৌড় লাগালাম,,,(না রে ভাই ভুত দেখি নাই)আমার বউ লাঠি হাতে পায়চারি করছে।পিছন থেকে হুমকির শুরে ডাক দিয়ে বলে উঠল,,,
ফারিহাঃজীবনের প্রতি মায়া থাকলে আর এক পাও সামনে না দিয়ে ঘরে ফিরে আয় বলছি!!
আমিঃআমি ভয়ে ভয়ে সামনে যেতেই,খপ করে কলার ধরে বলে উঠল,
ফারিহাঃআমি বাড়ি থেকে যাওয়ার পর এই অধঃপতন হইছে বুজি!রাত ১০ টায় বাসায় ফিরা হচ্ছে এখন!!(রাগি লুক নিয়ে)
আমিঃনা মানে,,,,,
ফারিহাঃআর মানে মানে করতে হবে না,,তোকে আর একা ছাড়া যাবে না,,,
আমিঃমানে!!!
ফারিহাঃমানে!! এখন থেকে আমি এখানেই থাকব।আর এই নে ৩০০০০(তিরিশ হাজার টাকা)এখন থেকে চাকরি খুজতে হবে না।ব্যবসা করবি।
আমিঃব্যবসা করব মানে!!কিসের ব্যবসা করব শুনি?
ফারিহাঃকিসের আবার!!কোন ব্যবসা খুজে না পেলে তোর এই ফুসকা পাগলিটার জন্য চটপটির আর ফুসকার দোকান দিবি।কিন্ত তোর দোকানের প্রথম কাস্টমার কিন্ত আমি হব।আর প্রতিদিন আমাকে ফ্রিতে ফুসকা খাওয়াতে হবে এই বলে দিলাম!!
আমিঃফুসকা খেয়ে মুটকি হওয়ার ইচ্ছা হয়েছে নাকি?
ফারিহাঃকি বললি তুই!!তবে রে শয়তান!(কিল ঘুসি দিতে দিতে)
আমিঃএই সরি,থাম থাম!!আগে বল এত টাকা তুমি কোথায় পেলে??
ফারিহাঃকোথায় আর পাব??আমার গহনা গুলা বিক্রি করে দিছি।
আমিঃকি!!তোমার এত সখের গহনা গুলা তুমি কেন বিক্রি করে দিস?(অবাক হয়ে)
ফারিহাঃকারন,ঐ গহনা গুলা ছাড়া আমি বেচে থাকতে পারব কিন্ত তোর মুখে চিন্তার ছাপ দেখে আমি বেচে থাকতে পারব না তাই(কান্না জড়িত কন্ঠে)!তুই চাকরির চিন্তায় চিন্তায় রাস্তায় দারিয়ে সিগারেট খাবি,নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিবি,তা আমি নিজের চোখে দেখে মেনে নিতে পারব না।আর সব থেকে বড় কথা হল,,,,,,,,(মুশকি হাসি দিয়ে)
আমিঃকি কথা আবার!!!
ফারিহাঃগর্ভবতী অবস্থায় একজন স্ত্রীর পাশে স্বামীর প্রযোজন অনেক বেশি(দুষ্টু হাসি দিয়ে)
আমিঃগর্ভবতী মানে!!!
ফারিহাঃনেকা!!কিছু বুঝে না(আমার নাক টিপ দিয়ে)আরে বুদ্দু তুমি বাবা হতে চলেছে(লজ্জায় মিশ্রিত হাসি দিয়ে)
আমিঃকি!!গত দুই মাস তুমি আমার সাথে ছিলে না,আর তুমি মা হতে চলেছ!সত্যি করে বল এই বাচ্চার বাবাকে??(মনে মনে শয়তান মার্কা হাসি দিয়ে)
ফারিহাঃকি বললে তুমি!!তুমি আমাকে সন্দেহ করছ”!(কান্না জড়িত কন্ঠে)
আমিঃঅবশ্যই!!তুমি কি ধোয়া তুলসী পাতা নাকি!!যে সন্দেহ করা যাবে না!!
ফারিহাঃকুত্তা এত বড় কথা তুই আমাকে বলতে পারলি!!জানিস আমার পেটে তিন মাসের বাচ্চা!!
আমিঃকি!!তোমার পেটে তিন মাসের বাচ্চা মানে!কিন্ত আমি ত কিছুই জানি না!!(এবার সত্যি অবাক হয়ে)
ফারিহাঃতুই কিভাবে জানবি!!তুই ত এটাও জানিস না,কেন আমি তোকে রেখে বাবার বাড়ি চলে গেছিলাম,,,
আমিঃকেন!!(আরো অবাক হয়ে)
ফারিহাঃকারন,যখন আমি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলাম,আমি মা হতে চলেছি তখন তোর চাকরি ছিল না।এই সময় যদি তোকে এই খবর দিতাম,তাহলে আরো তুই চিন্তায় পরে যেতি।আমি তোকে এই চিন্তা দিতে চাইনি!!আর টাকার জন্য তোকে প্রতি দিন দুশ্চিন্তা করতে দেখতাম কিন্ত আমিও এখানে থেকে তোকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারছিলাম না,,তাই বাবার বাড়ি চলে গেছিলাম,যাতে বাবার থেকে টাকা নিয়ে তোকে দিতে পারি।জানিস,তোকে ছাড়া থাকতে আমার কতটা কষ্ট হইছে?কত রাত আমি ঘুমাইনি!!আর তুই কিনা আমাকে(পুরা কথাটা না বলেই,মেয়েটা অঝর নয়নে কাঁদতে লাগল)
আমিঃচোখের কোনে আর জল ধরে রাখতে পারলাম না।একটা ছোট্র দুষ্টামি করতে গিয়ে আজ জানতে পারলাম,পাগলিটা বুকে কতটা কষ্ট জমা রেখে আমাকে এতটা ভালবাসত!!আজ আমিও কাঁদছি।তবে এ কান্না যেন,রোদ্র মিশ্রিত এক পশলা সুখের বৃষ্টিরমতন।পাগলিটা আর দূরে থাকতে পারলাম না,তাই কোলে তুলে নিয়ে ইচ্ছা মত কপালে চুমু একে দিলাম।
আমার আদরে পাগলিটার মুখে যে হাসি ফুটে উঠল তা দেখে মনে হচ্ছে,দিনের বেলা আকাশে চাঁদে হাসে উঠছে।এই হাসি যেন,জোসনা রাতে থালার মমত উদয় হওয়া একখানা বড় চাঁদের হাসি।
আশ্রু সিক্ত চোখ নিয়েও,ফারিহার চাঁদ মুখখানা দেখে আমার পছন্দের গানের দুইটা লাইন গেয়ে উঠলাম ,
লোকে বলে,আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে!!!
নাগো না,চাঁদ না,আমার বন্ধু এসেছে।
নাগো না,চাঁদ না,আমার বউ এসেছে
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com