প্রতিশোধের আগুন | Writer: Trisha Afrin
লাললালালা,লাললালালা,হুমহুহুমু,হুমহুহুমু।
এই কী হলো আজও ছেলেটা হা করে জানালা দিয়ে এইদিকে তাকিয়ে আছে?? কী ছেলেরে বাবা একেবারে নির্লজ্জ।প্রতিদিন এইভাবে জানালা দিয়ে একটা মেয়ের দিকে তাকাতেও তো লজ্জা করে নাকি?? আমি ছেলে হলে তো জীবনেও কোনো মেয়ের দিকে তাকাতাম না।আর তাকালেও দুরভাগ্যবশত একবারই তাকাতাম।কিন্তু এ ছেলে তো দেখি রোজ রোজ জানালা দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে।শুধু কী জানালা দিয়ে নাকি?? বিকালে যে একটু ছাদে যাবো তারও উপাই নেই।উনি ভালোই জানে আমি প্রতিদিন ছাদে যাই।তাই আমাকে ছাদে যাওয়া দেখলেই হয়,,সাথে সাথে উনিও হাজির হয়ে যাবে পাখির মতো থুক্কু রাক্ষসের মতো।
.
যাই হোক পাগলের মতো সেই কখন থেকে বকবক করে চলেছি।কোন ছেলের কথা বলছি সেটাই তো বলতে ভুলে গেছি।ওই রাক্ষসটির নাম হলো নিলয় আহম্মেদ নীল।সংক্ষেপে সবাই নীলই বলে ডাকে।তবে উনাকে আমি রাক্ষসই ভাবি।নীল অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।পাশাপাশি একটা জব করে।বাবা মায়ের একমাএ ছেলে নীল।ওর আর কোনো ভাই বোন নেই।ওর আব্বুর কানাডাই অনেক বড় বিজনেস আছে।আর আমি তৃষা আফরিন।বাবা মায়ের আদরের বড় কণ্যা।আমি ইনটার ফাস্ট ইয়ারে পড়ি।আমাদের বাসা থেকে নীলদের বাসা অনেক কাছাকাছি।মাঝখানে শুধু একটা রাস্তার ব্যবধান।মানে রাস্তার এপাশে আমাদের বাসা আর ওপাশে নীলদের বাসা।আমার রুমের জানালা থেকে ওর রুমের জানালা স্পর্ষ্ট দেখা যাই।আর সেই সুবিধাটা কাজে লাগিয়ে নীল জানালার কাছে দাড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
…..
-তৃষা দেখ,,ওই ছেলেটা প্রতিদিন কলেজে এসে তোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।(ইবনাত)
-কোন ছেলেটা রে ইবনাত ??(আমি)
-ওই দেখ গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে।(ইবনাত আমাদের রুমের সামনে একটা গাছের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো)
-ইবনাত আমি রুমে যাচ্ছি তুই কী যাবি??(আমি)
-না রে তৃষা তুই যা আমি একটু পরেই আসছি। (ইবনাত)
ইবনাতকে রেখে আমি একাই রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।ক্লাস রুমের সামনে যেতেই হঠাৎ নীল হুনুমানের মতো আমার সামনে এসে দাড়ালো।তারপর ঢং দেখিয়ে বলল:
-হ্যালো ম্যাম।(নীল)
-আচ্ছা আপনার কী কোনো লজ্জা শরম নাই বলুন তো,প্রতিদিন নিজের কাজে না গিয়ে, নিজের কলেজে না গিয়ে আমার কলেজে এসে দাড়াতে কী লজ্জা করে না বলুন তো।(আমি)
-না না একটুও করে না।জানো না লজ্জা,ঘৃণা,ভয় এই তিনটা জিনিস মানুষের জীবনে থাকতে নাই।তাই তো তুমি বার বার আমাকে ফিরিয়ে দিলেও সমস্ত লজ্জা,ঘৃণা,ভয় রেখে আবার তোমার কাছে ফিরে ফিরে আসি।(নীল)
-মানুষ হা হা হা হা,,আপনি তো একটা মানকি।এই জন্যই তো প্রতিটা দিন আমার কলেজে এসে দাড়িয়ে থাকেন আর কলেজ থেকে বাসায় ফেরার সময় রাস্তায় দাড়িয়ে থাকেন।(আমি)
-তৃষা বিশ্বাস করো,,সত্যি আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।প্লীজ আমাকে আর ফিরিয়ে দিওনা।(নীল)
ওর মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনে সত্যিই নিজের মনের ভেতরে একটা দোলা খেলে গেলো।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম:
-আপনি ভালোবাসেন তো আমি কী করব?? আপনার ভালোবাসা দিয়ে কী আমি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো??
-না সুন্দর করে রেখে দিবে।তৃষা আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।কেনো বোঝার চেষ্টা করোনা বলো তো?? আর জানো,তোমার সেই দুষ্টুকাল থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি।(নীল)
-ওই দাড়ান,দাড়ান।আপনি এইসব কথা কই পান বলুন তো?? দুষ্টুকালটা আবার কী ??(আমি)
-কেন তোমার ছোটকাল।জানো তুমি যখন এক পা দু পা করে হাটতে তখন থেকে তোমাকে ভালোবাসতাম।কিন্তু বলার সাহস পাইনি যদি ছোট হাতে একটা মেরে দাও।তবে তুমি তো জানো সমস্ত বাদ ভাঙিয়ে তুমি ক্লাস নাইনে থাকতে তোমাকে প্রপোচ করেছিলাম।তবুও তুমি এই দুই তিনটা বছর ঝুলিয়ে রেখেছো।আহা কী যে কষ্ট এই প্রেমিকের মনের মধ্যে।(নীল)
-বাব্বা,এ তো দেখছি আমার সামনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসে হাজির হয়েছে।তবে এতদিন জানতাম গল্পে গরু গাছে ওঠে কিন্তু এখন দেখছি আকাশে উঠছে(এটা কথাটা অবশ্য আমি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে থাকি)।মেয়ে পটানো ভাষা তো দেখছি অনেক শিখে গেছেন।(বলেই নীলকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে রুমে চলে গেলাম।আমি জানি নীল সত্যিই আমাকে ভালোবাসে।এমনকি ওর আব্বুর সাথেও আমাকে নিয়ে কথা বলেছে ও)
আমাদের এ কথা দুর থেকে সাব্বির আর আরিফুল দেখতে পেলো।ওদের চোখে নীলের জন্য অফুরন্ত রাগ দেখতে পেলাম।আর এটাও জানি ওরা এই খবরটা রাকিবকে এখনি দিবে।আরিফুল নামের ছেলেটা আর রাকিব এরা দুজনেই আবার আমাকে ভালোবাসে।এই নিয়ে অনেকবার আরিফুল আর রাকিবের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে তবে সেটা ওরা আবার সমাধানও করে নিয়েছে।বখাটের ভালোবাসা যেমন হয় আর কী।তবে রাকিব আরিফুলের লিডার হওয়ার জন্য ওর উপরে কথা বলতে পারেনা।কিন্তু ওদের পথে নীল বারবার বাধা হয়ে দাড়াই।যার জন্য নীলকে ওরা একটুও পছন্দ করেনা।ওরা আমাদের একই এলাকারই ছেলে।সাব্বির,আরিফুল,রাকিব ওরা এই এলাকার নামকরা মাস্তান।জোয়া খেলা,মেয়েদের ইভটিজিং করা,মদ,গাঁজা খাওয়া থেকে শুরু করে সবরকম খারাপ কাজ ওদের দ্বারা সম্ভব।আর নীল হলো ওদের থেকে পুরোপুরি আলাদা স্বভাবের।নীলদের “যুবলীগ শান্তিসংঘ” নামে একটা প্রতিষ্ঠান ছিল।যে প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল অসামাজিক কর্মকান্ডকে নস্যাৎ করা।আর সকল দুর্নিতি চাঁদাবাজকে দমন করা।নীল,প্রধান,সোহান,অয়ন,সাকিল,তানভীর ছিল ওই শান্তিসংঘের রক্ষতা।কিন্তু নীল ছিল সবার মেইনে,সমস্ত বিশাল বিশাল দায়িত্ব ছিল নীলের উপরে।সেই দুর্নিতিবাজ কোয়ালিটির বাজে ছেলে আরিফুল,সাব্বির আর রাকিব।আর তাই ওরা নীলকে একটুও সহ্য করতে পারত না।রাকীবের সবচেয়ে রাগ ছিল নীলের উপরে কারণ নীল আমাকে ভালোবাসতো।রাকীবের বিভিন্ন ধরনের রাগ এসে ঘিরে ধরেছিল নীলকে।
.
কলেজ ছুটির পরে বাসায় ফিরছি।রাস্তায় রাক্ষসটা যেখানে দাড়িয়ে থাকে আজ দেখি ও ওখানে নেই।যাক বাবা এক ধাক্কা দেওয়াতে মনে হয় একটু শোধরেছে।হঠাৎ সামনে ফিরতেই কিছু একটার সাথে জোড়ে একটা ধাক্কা খেলাম।আহা কী যে ব্যাথা পেলাম মাথায়।সাথে সাথে চোখটা বুজে ফেললাম।মনে মনে ভাবলাম,হয়তো খেয়াল না করে চলার জন্য কোনো গাছের সাথে ধাক্কা খেয়েছি।কিন্তু একি চোখ মেলতেই দেখি নীল।ওহ শিট তার মানে আমি নীলের সাথে ধাক্কা খেয়েছি ??নীলও ওর কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল:
-এই রাস্তার দেখেশুনে চলতে পারোনা?? ভালোই হয়েছে আমার সাথে ধাক্কাটা খেয়েছো।অন্য কারো সাথে ধাক্কা খেলে তো আমি সহ্য করতে না পেরে মনের কষ্টে কেদেই দিতাম।(নীল)
-এই রাখুন তো আপনার কষ্ট।নিজে দেখে চলতে পারেন না??আমি মাথায় ব্যাথা পেয়েছি আর উনি কষ্ট দেখাচ্ছে।(আমি)
-আহারে,আমি মনে হয় ব্যাথা পাইনি?? তখন আমাকে ফেলে দিয়েছিলে বলে ভেবেছিলাম হঠাৎ তোমার সামনে এসে তোমাকে ভয় পাইয়ে দিব।কিন্তু জানতাম কি যে এভাবে আবার ব্যাথা পাবো।তখনও ব্যাথা পেয়েছি আর এখনও ব্যাথা পেলাম।(নীল)
-হুমম আজ তো সামান্য ব্যাথা পেয়েছেন এর পরে যদি আর কখনো সামনে আসেন তাহলে অন্য রকম হবে।বলেই নীলের পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে দেখি রাকিব দাড়িয়ে আছে।না আজ রাকিবের সামনেই পড়তে হলো।ওদের ওখানে না দাড়িয়ে সোজা বাসায় চলে আসলাম।প্রতিদিনের মতো আজও বিকালে ছাদে গেলাম।আসলে বিকালে ছাদের মনোমুদ্ধকর পরিবেশ আমার অনেক ভালো লাগে।এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে নীলদের ছাদের দিকে চোখ গেলো ।হুমম আজও নীল দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বুদ্ধুর মতো ফ্যালফ্যাল করে হাসছে।আসলেই ওর হাসিটা অনেক সুন্দর।আমিও অপলকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ সম্ভব হলোনা।একটু পরে ছোটবোন এসে বলল,আপু আম্মু তোমাকে নিচে ডাকছে।আমিও বাদ্ধ মেয়ের মতো নিচে চলে আসলাম।
পরের দিন সকালে।কলেজে যাবো বলে রেডি হয়েছি এই সময় আম্মু এসে বলল,,
-মামনি,আজ তোমার কলেজে যেতে হবে না।
-কেন আম্মু ?? আর কলেজে তো যেতেই হবে।(নীলকে দেখার উদ্দেশ্যে)
-না মা,আমি তোমার আব্বু কেউই বাসায় থাকছি না।তোমার চাচ্চু অনেক অসুস্ত তাই যেতে হচ্ছে।আজ তোমাকে বাসায় থাকতে হবে।
আমার আবার বাসায় একা একা থাকতে অনেক ভালো লাগে।কেউ বাসায় না থাকলে একা একা টিভি দেখা যাই,আইসক্রীম খাওয়া যায় কেউ নিষেধ করে না।তাই আম্মুর এক কথায় বাসায় থেকে গেলাম।বসে বসে টিভিতে কার্টুন দেখছি এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।কার্টুন দেখার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে মনে হয় তাকে আস্ত গিলে ফেলি।তাই ফোনটা বেজে যাওয়া স্বত্তেও আমি ফোনটা রিসিভ করছি না।কিন্তু যে ফোন দিচ্ছে সেও নাছোড় বান্দা ফোন রিসিভ করিয়েই ছাড়বে।শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রাগে রাগে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে,,
-হ্যালো মিস তৃষা ।কার্টুন কেমন দেখছেন হুমম??(ভালোভাবেই বুঝলাম এটা নীলের গলা)
-এই আপনি আমার বাসার নাম্বারে ফোন করেছেন কেন?? আর বুঝলেন কী করে যে ফোনটা আমিই রিসিভ করব??
-কেন বুঝব না শুনি?? বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম তোমার কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্য।কিন্তু বের হতেই দেখি আন্টি আংকেল কোথায় যেন যাচ্ছে।তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আজ তুমি কলেজে যাবে না।তাই আমিও তোমাকে ফোন দেওয়া শুরু করি।জানতাম আন্টি চলে যাওয়ার সাথে সাথে তুমি কার্টুন দেখছো তাই ফোন ধরছো না।সে জন্যই তো আমি ফোন দিতেই আছি,দিতেই আছি।
-হুমম, তাহলে এখনো আমার কলেজ যাওয়ার সাধটা মেটেনি?? শোনেন মিষ্টার নীল আর যদি কোনোদিন আমার সামনে গিয়ে দাড়ান তাহলে সেদিন কিন্তু ফল ভালো হবে না,ভালোভাবেই বলে দিলাম।
নীল আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল,
-অনেক ভালোবাসি,শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।বিশ্বাস করো তৃষা ।
নীলের কথাই আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
-আগেও বলেছি এখনও বলছি,, I love you Trisha.But do you love me??
নীলের মুখে আবারও এই কথা শুনে নিজের ভেতরেই কেমন একটা ফিল হতে লাগল।মনটা কেমন নরম হয়ে গেলো।নিজের অজান্তেই কখন নীলকে বলে ফেললাম,,
-হুমম বাসিতো,অনেক ভালোবাসি নীল তোমাকে ।সত্যিই তৃষা তুমি আমাকে ভালোবাসো?? আমি জানতাম তুমি আমাকে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
নীলের কথা শুনে নিজের কাছে নিজেরই লজ্জিত মনে হলো।ছি ছি এ কী বললাম আমি?? আবেগ দিয়ে ভালোবাসা হয়না।আর আমি ওকে কেন ভালোবাসতে যাবো?? যেটা বলেছি শুধুমাএ আবেগের বসে বলে ফেলেছি।
-ওই কে বলেছে আমি আপনাকে ভালোবাসি?? আমি মোটেও আপনাকে ভালোবাসি না ।নীল তখন হাসি মুখে বলল,
-সে তো তুমি নিজের মুখেই একটু আগে বললে।ওইটাই তোমার মনের কথা,,এইটা নয়।দাড়াও আজই বন্ধুমহলে একটা পার্টি দিবো।(নীল আবার সবসময় আনন্দিত মুডে থাকতে ভালোবাসে।তাই অধিকাংশ সময় পার্টি নিয়েই বিজি থাকে)
-দেখুন আপনার যা খুশি তাই করুন তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি না ।আর কখনো আপনি আমার সামনে আসবেন না।
-বেশ আমিও প্রমাণ করেই ছাড়বো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, বলেই নীল ফোনটা কেটে দিলো।
নীলের কথাগুলো মনে পড়লে সত্যিই অনেক ভালো লাগছে।আচ্ছা তাহলে কী আমি সত্যিই নীলকে ভালোবেসে ফেললাম?? তা না হলে কেন বারবার আমি ওর কথা ভাবি?? ডেতত,আমি এসব কী ভাবছি পাগলের মতো??
এইভাবে দিনগুলো অনেক ভালোই যাচ্ছিলো।প্রতিদিনের রুটিন মতো ভালোই চলছিলাম।বন্ধুদের সাথে আড্ডা,পার্টি করা,লেখাপড়া সবকিছুর মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠছিলাম।একটা সাধারণ কিশোরীর স্বপ্নের মতো স্বপ্নের বীজ বুনে তৈরী হয়েছিলো নিজের মনের মধ্যখান।আনন্দই ছিল সবসময় আমার সঙ্গী।কিন্তু কে বলেছিলো এই সরল মনের নরম মেয়েটিই একসময় “প্রতিশোধের আগুনে” জ্বলে পুড়ে উঠবে?? যে মেয়ে অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারত না,সেই মেয়েটি নিজেই একদিন অন্যের মৃত্যুর কামনাই উঠে পড়ে লাগবে??
.
পরপর তিনদিন কলেজে গেলাম কিন্তু নীলের কোনো দেখা পেলাম না।নীল আমার কলেজে আর যাই না,কলেজ ছুটির পরেও আর রাস্তায় দাড়িয়ে থাকেনা,ছাদেও যাই না,আবার জানালার পাশে এসেও দাড়াই না।এই কয়দিন নীলকে অনেক খুজেছি কিন্তু কোথাও নীলের দেখা পেলাম না।নীলকে না দেখতে পেয়ে এই কয়দিন সত্যিই অনেক কষ্ট হচ্ছিলো।কোনো কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না।চার দিনের দিন কলেজ গেলাম তবুও নীলের দেখা পেলাম না।যখন বাসায় ফিরছি হঠাৎ নীল কোথা থেকে যেন আমার সামনে দাড়ালো।ওকে দেখে যেন শতো রাজ্যের সুখ এসে আমার মধ্যে ভির করল।ওকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম যে কেনো ও এই কয়দিন আমার সামনে আসেনি,তবুও চুপ করে থাকলাম।
-এই যে ম্যাম, এই কয়দিন কেমন কাটালে??
-অনেক ভালো আর আপনার মুখ না দেখাতে আরও অনেক ভালো ছিলাম।
-হুমম, সেটা আমি খুব ভালোই জানি যে তুমি কেমন ভালো ছিলে,আমি কী আর বুঝি না??
-মানে আপনি কী বলতে চাইছেন ??
-কী ভেবেছিলে আমি এই কয়দিন তোমাকে না দেখে ছিলাম??না আমি প্রতিদিনই আসতাম তবে তোমাকে দেখা দিতাম না তোমার আড়ালে থাকতাম।আর এটাও দেখতাম তুমি আমাকে খুজছো।তোমার ওই দিশেহারা চোখ দেখে আর থাকতে পারলাম না,সামনে আসতেই হলো।
-দেখুন মিষ্টার নীল,আপনার ধারণা ভুল।একটা মানুষ সামনে আসতে আসতে হঠাৎ না আসলে তাকে খোজাই স্বাভাবিক।আমি কখনোই আপনাকে ভালোবাসিনি।
এবার নীল আমার হঠাৎ আমার হাত ধরল।তারপর বলল,,
-তুমি মুখেই বললে হবে না, তোমার মুখ বলছে তুমি আমাকে ভালোবাসো,তোমার চোখ বলছে তুমি আমাকে ভালোবাসো।
নীলের এইরকম ব্যবহার আমি সহ্য করতে পারিনি।তাই ঠাস করে ওর মুখে একটা চর দিলাম।নীল আর একটা কথা না বলে মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইল।ওর চোখ দিয়ে অঝরে পানি গড়িয়ে পড়ছে।তবে কেন জানিনা আমার বুকের ভেতরটা ফেটে চৌঁচির হয়ে যাচ্ছে।চর মারাতে হয়তো ওর মানসন্মানে আঘাত লেগেছে কিন্তু কষ্টটা হয়তো আমারই বেশি হচ্ছে।আমিও চুপচাপ দাড়িয়ে আছি।নীলকে কী বলব কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা।রাগের বশত এটা কী করে ফেললাম আমি?? সমস্ত নীরাবতা ভাঙিয়ে নীল কাদোকাদো ভাবে বলে উঠল,,
-ঠিক আছে তৃষা, আমারই ভাবনার ভুল ছিল ।আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমাকে ভালোবাসো,তাই এতো অধিকার দেখিয়েছিলাম।কিন্তু এখন আমি বুঝতে পেরেছি তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো না।আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমার সামনে আসব না,কখনোই না।তবে আমার শেষ একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে??(ওকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।তবে ও যদি আর সত্যিই আমার সামনে না আসে তবে অনেক কষ্ট হবে আমার এইটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলাম)
-জি বলেন।
-আজ সন্ধ্যাবেলাই একটা পার্টির ব্যবস্তা করেছিলাম,আমি চাই তুমি ওখানে এসো।প্লীজ তৃষা না করো না আমার এই শেষ কথাটা রাখো।
-না আমি কেনো জাবো?? আমি কিছুতেই জাবো না।
বলেই আমি পিছু ফিরে চলে আসলাম।পেছন থেকে নীল বলতে লাগল,প্লীজ তৃষা তুমি এসো আমি তোমার অপেক্ষাতেই থাকব।
বাসায় চলে আসলাম।তবে কিছুতেই আজ মনে শান্তি পাচ্ছিনা।মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে।অশান্তির মধ্য দিয়েই সারাটা দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।হুমম,নীল বলেছিলো সন্ধ্যাবেলাই পার্টিতে যেতে।ও নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করবে।হ্যাঁ,আমাকে যেতেই হবে।তাই ফ্রেশ হয়ে তারাতারি পার্টিতে চলে গেলাম।ওখানে গিয়ে দেখি নীল পাইচারি করছে।আর ওর বন্ধু প্রধান নীলের হাত ধরে বারবার ওকে বোঝাচ্ছে দেখ পাগলামী করিসনা,তৃষা আসবেনা আমি বলছি।কিন্তু নীল বলছে,না আসবে আমার বিশ্বাস তৃষা ঠিক আসবে,আমার মন বলছে।নীল প্রধানের কাছ থেকে জোড় করে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এদিকে ফিরতেই আমার দিকে তাকিয়ে পড়ল,আমাকে দেখে ওর মুখে হাসি ফুঁটে উঠল।কিন্তু আজ পার্টিতে নীলের মুখে কোনো হাসি নেই।যে ছেলেটা পার্টিতে আসলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই আজ তার চোখে পানির রেখা দেখা যাচ্ছে।মনে হচ্ছে এইটাই ওর শেষ পার্টি।ও অপলকে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে।পার্টির এক পর্যায়ে নীলের বন্ধু সোহান বলল,,এবার গান শুরু করা যাক।কিন্তু কে আগে গান শুরু করবে এই নিয়ে হলো ঝামেলা।শেষ পর্যন্ত নীলকেই সিলেক্ট করা হলো কারণ ওই পার্টিটার এ্যরেজমেন্ট করেছিল।কিছুক্ষণ পরে নীল আমার দিকে একবার তাকিয়ে গান গাওয়া শুরু করল,,
“” যদি আর আমি ফিরে নাহি আসি,তুমি আমাকে কভু ভুলে যেওনা,,হৃদয়ের মনিকোঠায় সৃতিরও পাতায় পাতায় আমারই নামে করো আলপনা,,,যদি কোনো ভুল করে থাকি,ক্ষমা করে দিয়ো,ও গো সাথী এই কামনাই আমি রাখি,,,,,,,,,””
গানটা গাওয়ার সময় নীলের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।একি যে ছেলেটা পার্টিতে এসে সবসময় অন্যের মুডকে ভালো করে দেই গান গেয়ে আজ সেইই এমন একটা গান গাইছে।ওর বন্ধুরাও অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।এবার আমিও নিজের চোখকে আটকে রাখতে পারলাম না।ওখানে আর এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে সোজা বাসায় চলে আসলাম।
আমার কেন এমন হচ্ছে নীলের জন্য?? কেন ওকে বারবার দেখতে মন চাই?? কেন ওর চোখের পানি আমাকেও কষ্ট দেই?? তাহলে কী আমিও ওকে ভালোবেসে ফেললাম?? মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন এসে জমাট বেধেছে।হুমম বুঝেছি আমিও নীলকে ভালোবাসি।না ওকে আর কষ্ট দেওয়া যাবেনা।এবার ওকে বলতেই হবে যে আমিও ওকে ভালোবাসি।……………
এই কী হলো আজও ছেলেটা হা করে জানালা দিয়ে এইদিকে তাকিয়ে আছে?? কী ছেলেরে বাবা একেবারে নির্লজ্জ।প্রতিদিন এইভাবে জানালা দিয়ে একটা মেয়ের দিকে তাকাতেও তো লজ্জা করে নাকি?? আমি ছেলে হলে তো জীবনেও কোনো মেয়ের দিকে তাকাতাম না।আর তাকালেও দুরভাগ্যবশত একবারই তাকাতাম।কিন্তু এ ছেলে তো দেখি রোজ রোজ জানালা দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে।শুধু কী জানালা দিয়ে নাকি?? বিকালে যে একটু ছাদে যাবো তারও উপাই নেই।উনি ভালোই জানে আমি প্রতিদিন ছাদে যাই।তাই আমাকে ছাদে যাওয়া দেখলেই হয়,,সাথে সাথে উনিও হাজির হয়ে যাবে পাখির মতো থুক্কু রাক্ষসের মতো।
.
যাই হোক পাগলের মতো সেই কখন থেকে বকবক করে চলেছি।কোন ছেলের কথা বলছি সেটাই তো বলতে ভুলে গেছি।ওই রাক্ষসটির নাম হলো নিলয় আহম্মেদ নীল।সংক্ষেপে সবাই নীলই বলে ডাকে।তবে উনাকে আমি রাক্ষসই ভাবি।নীল অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।পাশাপাশি একটা জব করে।বাবা মায়ের একমাএ ছেলে নীল।ওর আর কোনো ভাই বোন নেই।ওর আব্বুর কানাডাই অনেক বড় বিজনেস আছে।আর আমি তৃষা আফরিন।বাবা মায়ের আদরের বড় কণ্যা।আমি ইনটার ফাস্ট ইয়ারে পড়ি।আমাদের বাসা থেকে নীলদের বাসা অনেক কাছাকাছি।মাঝখানে শুধু একটা রাস্তার ব্যবধান।মানে রাস্তার এপাশে আমাদের বাসা আর ওপাশে নীলদের বাসা।আমার রুমের জানালা থেকে ওর রুমের জানালা স্পর্ষ্ট দেখা যাই।আর সেই সুবিধাটা কাজে লাগিয়ে নীল জানালার কাছে দাড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
…..
-তৃষা দেখ,,ওই ছেলেটা প্রতিদিন কলেজে এসে তোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।(ইবনাত)
-কোন ছেলেটা রে ইবনাত ??(আমি)
-ওই দেখ গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে।(ইবনাত আমাদের রুমের সামনে একটা গাছের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো)
-ইবনাত আমি রুমে যাচ্ছি তুই কী যাবি??(আমি)
-না রে তৃষা তুই যা আমি একটু পরেই আসছি। (ইবনাত)
ইবনাতকে রেখে আমি একাই রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।ক্লাস রুমের সামনে যেতেই হঠাৎ নীল হুনুমানের মতো আমার সামনে এসে দাড়ালো।তারপর ঢং দেখিয়ে বলল:
-হ্যালো ম্যাম।(নীল)
-আচ্ছা আপনার কী কোনো লজ্জা শরম নাই বলুন তো,প্রতিদিন নিজের কাজে না গিয়ে, নিজের কলেজে না গিয়ে আমার কলেজে এসে দাড়াতে কী লজ্জা করে না বলুন তো।(আমি)
-না না একটুও করে না।জানো না লজ্জা,ঘৃণা,ভয় এই তিনটা জিনিস মানুষের জীবনে থাকতে নাই।তাই তো তুমি বার বার আমাকে ফিরিয়ে দিলেও সমস্ত লজ্জা,ঘৃণা,ভয় রেখে আবার তোমার কাছে ফিরে ফিরে আসি।(নীল)
-মানুষ হা হা হা হা,,আপনি তো একটা মানকি।এই জন্যই তো প্রতিটা দিন আমার কলেজে এসে দাড়িয়ে থাকেন আর কলেজ থেকে বাসায় ফেরার সময় রাস্তায় দাড়িয়ে থাকেন।(আমি)
-তৃষা বিশ্বাস করো,,সত্যি আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।প্লীজ আমাকে আর ফিরিয়ে দিওনা।(নীল)
ওর মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনে সত্যিই নিজের মনের ভেতরে একটা দোলা খেলে গেলো।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম:
-আপনি ভালোবাসেন তো আমি কী করব?? আপনার ভালোবাসা দিয়ে কী আমি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো??
-না সুন্দর করে রেখে দিবে।তৃষা আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।কেনো বোঝার চেষ্টা করোনা বলো তো?? আর জানো,তোমার সেই দুষ্টুকাল থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি।(নীল)
-ওই দাড়ান,দাড়ান।আপনি এইসব কথা কই পান বলুন তো?? দুষ্টুকালটা আবার কী ??(আমি)
-কেন তোমার ছোটকাল।জানো তুমি যখন এক পা দু পা করে হাটতে তখন থেকে তোমাকে ভালোবাসতাম।কিন্তু বলার সাহস পাইনি যদি ছোট হাতে একটা মেরে দাও।তবে তুমি তো জানো সমস্ত বাদ ভাঙিয়ে তুমি ক্লাস নাইনে থাকতে তোমাকে প্রপোচ করেছিলাম।তবুও তুমি এই দুই তিনটা বছর ঝুলিয়ে রেখেছো।আহা কী যে কষ্ট এই প্রেমিকের মনের মধ্যে।(নীল)
-বাব্বা,এ তো দেখছি আমার সামনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসে হাজির হয়েছে।তবে এতদিন জানতাম গল্পে গরু গাছে ওঠে কিন্তু এখন দেখছি আকাশে উঠছে(এটা কথাটা অবশ্য আমি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে থাকি)।মেয়ে পটানো ভাষা তো দেখছি অনেক শিখে গেছেন।(বলেই নীলকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে রুমে চলে গেলাম।আমি জানি নীল সত্যিই আমাকে ভালোবাসে।এমনকি ওর আব্বুর সাথেও আমাকে নিয়ে কথা বলেছে ও)
আমাদের এ কথা দুর থেকে সাব্বির আর আরিফুল দেখতে পেলো।ওদের চোখে নীলের জন্য অফুরন্ত রাগ দেখতে পেলাম।আর এটাও জানি ওরা এই খবরটা রাকিবকে এখনি দিবে।আরিফুল নামের ছেলেটা আর রাকিব এরা দুজনেই আবার আমাকে ভালোবাসে।এই নিয়ে অনেকবার আরিফুল আর রাকিবের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে তবে সেটা ওরা আবার সমাধানও করে নিয়েছে।বখাটের ভালোবাসা যেমন হয় আর কী।তবে রাকিব আরিফুলের লিডার হওয়ার জন্য ওর উপরে কথা বলতে পারেনা।কিন্তু ওদের পথে নীল বারবার বাধা হয়ে দাড়াই।যার জন্য নীলকে ওরা একটুও পছন্দ করেনা।ওরা আমাদের একই এলাকারই ছেলে।সাব্বির,আরিফুল,রাকিব ওরা এই এলাকার নামকরা মাস্তান।জোয়া খেলা,মেয়েদের ইভটিজিং করা,মদ,গাঁজা খাওয়া থেকে শুরু করে সবরকম খারাপ কাজ ওদের দ্বারা সম্ভব।আর নীল হলো ওদের থেকে পুরোপুরি আলাদা স্বভাবের।নীলদের “যুবলীগ শান্তিসংঘ” নামে একটা প্রতিষ্ঠান ছিল।যে প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল অসামাজিক কর্মকান্ডকে নস্যাৎ করা।আর সকল দুর্নিতি চাঁদাবাজকে দমন করা।নীল,প্রধান,সোহান,অয়ন,সাকিল,তানভীর ছিল ওই শান্তিসংঘের রক্ষতা।কিন্তু নীল ছিল সবার মেইনে,সমস্ত বিশাল বিশাল দায়িত্ব ছিল নীলের উপরে।সেই দুর্নিতিবাজ কোয়ালিটির বাজে ছেলে আরিফুল,সাব্বির আর রাকিব।আর তাই ওরা নীলকে একটুও সহ্য করতে পারত না।রাকীবের সবচেয়ে রাগ ছিল নীলের উপরে কারণ নীল আমাকে ভালোবাসতো।রাকীবের বিভিন্ন ধরনের রাগ এসে ঘিরে ধরেছিল নীলকে।
.
কলেজ ছুটির পরে বাসায় ফিরছি।রাস্তায় রাক্ষসটা যেখানে দাড়িয়ে থাকে আজ দেখি ও ওখানে নেই।যাক বাবা এক ধাক্কা দেওয়াতে মনে হয় একটু শোধরেছে।হঠাৎ সামনে ফিরতেই কিছু একটার সাথে জোড়ে একটা ধাক্কা খেলাম।আহা কী যে ব্যাথা পেলাম মাথায়।সাথে সাথে চোখটা বুজে ফেললাম।মনে মনে ভাবলাম,হয়তো খেয়াল না করে চলার জন্য কোনো গাছের সাথে ধাক্কা খেয়েছি।কিন্তু একি চোখ মেলতেই দেখি নীল।ওহ শিট তার মানে আমি নীলের সাথে ধাক্কা খেয়েছি ??নীলও ওর কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল:
-এই রাস্তার দেখেশুনে চলতে পারোনা?? ভালোই হয়েছে আমার সাথে ধাক্কাটা খেয়েছো।অন্য কারো সাথে ধাক্কা খেলে তো আমি সহ্য করতে না পেরে মনের কষ্টে কেদেই দিতাম।(নীল)
-এই রাখুন তো আপনার কষ্ট।নিজে দেখে চলতে পারেন না??আমি মাথায় ব্যাথা পেয়েছি আর উনি কষ্ট দেখাচ্ছে।(আমি)
-আহারে,আমি মনে হয় ব্যাথা পাইনি?? তখন আমাকে ফেলে দিয়েছিলে বলে ভেবেছিলাম হঠাৎ তোমার সামনে এসে তোমাকে ভয় পাইয়ে দিব।কিন্তু জানতাম কি যে এভাবে আবার ব্যাথা পাবো।তখনও ব্যাথা পেয়েছি আর এখনও ব্যাথা পেলাম।(নীল)
-হুমম আজ তো সামান্য ব্যাথা পেয়েছেন এর পরে যদি আর কখনো সামনে আসেন তাহলে অন্য রকম হবে।বলেই নীলের পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে দেখি রাকিব দাড়িয়ে আছে।না আজ রাকিবের সামনেই পড়তে হলো।ওদের ওখানে না দাড়িয়ে সোজা বাসায় চলে আসলাম।প্রতিদিনের মতো আজও বিকালে ছাদে গেলাম।আসলে বিকালে ছাদের মনোমুদ্ধকর পরিবেশ আমার অনেক ভালো লাগে।এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে নীলদের ছাদের দিকে চোখ গেলো ।হুমম আজও নীল দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বুদ্ধুর মতো ফ্যালফ্যাল করে হাসছে।আসলেই ওর হাসিটা অনেক সুন্দর।আমিও অপলকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ সম্ভব হলোনা।একটু পরে ছোটবোন এসে বলল,আপু আম্মু তোমাকে নিচে ডাকছে।আমিও বাদ্ধ মেয়ের মতো নিচে চলে আসলাম।
পরের দিন সকালে।কলেজে যাবো বলে রেডি হয়েছি এই সময় আম্মু এসে বলল,,
-মামনি,আজ তোমার কলেজে যেতে হবে না।
-কেন আম্মু ?? আর কলেজে তো যেতেই হবে।(নীলকে দেখার উদ্দেশ্যে)
-না মা,আমি তোমার আব্বু কেউই বাসায় থাকছি না।তোমার চাচ্চু অনেক অসুস্ত তাই যেতে হচ্ছে।আজ তোমাকে বাসায় থাকতে হবে।
আমার আবার বাসায় একা একা থাকতে অনেক ভালো লাগে।কেউ বাসায় না থাকলে একা একা টিভি দেখা যাই,আইসক্রীম খাওয়া যায় কেউ নিষেধ করে না।তাই আম্মুর এক কথায় বাসায় থেকে গেলাম।বসে বসে টিভিতে কার্টুন দেখছি এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।কার্টুন দেখার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে মনে হয় তাকে আস্ত গিলে ফেলি।তাই ফোনটা বেজে যাওয়া স্বত্তেও আমি ফোনটা রিসিভ করছি না।কিন্তু যে ফোন দিচ্ছে সেও নাছোড় বান্দা ফোন রিসিভ করিয়েই ছাড়বে।শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রাগে রাগে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে,,
-হ্যালো মিস তৃষা ।কার্টুন কেমন দেখছেন হুমম??(ভালোভাবেই বুঝলাম এটা নীলের গলা)
-এই আপনি আমার বাসার নাম্বারে ফোন করেছেন কেন?? আর বুঝলেন কী করে যে ফোনটা আমিই রিসিভ করব??
-কেন বুঝব না শুনি?? বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম তোমার কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্য।কিন্তু বের হতেই দেখি আন্টি আংকেল কোথায় যেন যাচ্ছে।তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আজ তুমি কলেজে যাবে না।তাই আমিও তোমাকে ফোন দেওয়া শুরু করি।জানতাম আন্টি চলে যাওয়ার সাথে সাথে তুমি কার্টুন দেখছো তাই ফোন ধরছো না।সে জন্যই তো আমি ফোন দিতেই আছি,দিতেই আছি।
-হুমম, তাহলে এখনো আমার কলেজ যাওয়ার সাধটা মেটেনি?? শোনেন মিষ্টার নীল আর যদি কোনোদিন আমার সামনে গিয়ে দাড়ান তাহলে সেদিন কিন্তু ফল ভালো হবে না,ভালোভাবেই বলে দিলাম।
নীল আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল,
-অনেক ভালোবাসি,শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।বিশ্বাস করো তৃষা ।
নীলের কথাই আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
-আগেও বলেছি এখনও বলছি,, I love you Trisha.But do you love me??
নীলের মুখে আবারও এই কথা শুনে নিজের ভেতরেই কেমন একটা ফিল হতে লাগল।মনটা কেমন নরম হয়ে গেলো।নিজের অজান্তেই কখন নীলকে বলে ফেললাম,,
-হুমম বাসিতো,অনেক ভালোবাসি নীল তোমাকে ।সত্যিই তৃষা তুমি আমাকে ভালোবাসো?? আমি জানতাম তুমি আমাকে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
নীলের কথা শুনে নিজের কাছে নিজেরই লজ্জিত মনে হলো।ছি ছি এ কী বললাম আমি?? আবেগ দিয়ে ভালোবাসা হয়না।আর আমি ওকে কেন ভালোবাসতে যাবো?? যেটা বলেছি শুধুমাএ আবেগের বসে বলে ফেলেছি।
-ওই কে বলেছে আমি আপনাকে ভালোবাসি?? আমি মোটেও আপনাকে ভালোবাসি না ।নীল তখন হাসি মুখে বলল,
-সে তো তুমি নিজের মুখেই একটু আগে বললে।ওইটাই তোমার মনের কথা,,এইটা নয়।দাড়াও আজই বন্ধুমহলে একটা পার্টি দিবো।(নীল আবার সবসময় আনন্দিত মুডে থাকতে ভালোবাসে।তাই অধিকাংশ সময় পার্টি নিয়েই বিজি থাকে)
-দেখুন আপনার যা খুশি তাই করুন তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি না ।আর কখনো আপনি আমার সামনে আসবেন না।
-বেশ আমিও প্রমাণ করেই ছাড়বো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, বলেই নীল ফোনটা কেটে দিলো।
নীলের কথাগুলো মনে পড়লে সত্যিই অনেক ভালো লাগছে।আচ্ছা তাহলে কী আমি সত্যিই নীলকে ভালোবেসে ফেললাম?? তা না হলে কেন বারবার আমি ওর কথা ভাবি?? ডেতত,আমি এসব কী ভাবছি পাগলের মতো??
এইভাবে দিনগুলো অনেক ভালোই যাচ্ছিলো।প্রতিদিনের রুটিন মতো ভালোই চলছিলাম।বন্ধুদের সাথে আড্ডা,পার্টি করা,লেখাপড়া সবকিছুর মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠছিলাম।একটা সাধারণ কিশোরীর স্বপ্নের মতো স্বপ্নের বীজ বুনে তৈরী হয়েছিলো নিজের মনের মধ্যখান।আনন্দই ছিল সবসময় আমার সঙ্গী।কিন্তু কে বলেছিলো এই সরল মনের নরম মেয়েটিই একসময় “প্রতিশোধের আগুনে” জ্বলে পুড়ে উঠবে?? যে মেয়ে অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারত না,সেই মেয়েটি নিজেই একদিন অন্যের মৃত্যুর কামনাই উঠে পড়ে লাগবে??
.
পরপর তিনদিন কলেজে গেলাম কিন্তু নীলের কোনো দেখা পেলাম না।নীল আমার কলেজে আর যাই না,কলেজ ছুটির পরেও আর রাস্তায় দাড়িয়ে থাকেনা,ছাদেও যাই না,আবার জানালার পাশে এসেও দাড়াই না।এই কয়দিন নীলকে অনেক খুজেছি কিন্তু কোথাও নীলের দেখা পেলাম না।নীলকে না দেখতে পেয়ে এই কয়দিন সত্যিই অনেক কষ্ট হচ্ছিলো।কোনো কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না।চার দিনের দিন কলেজ গেলাম তবুও নীলের দেখা পেলাম না।যখন বাসায় ফিরছি হঠাৎ নীল কোথা থেকে যেন আমার সামনে দাড়ালো।ওকে দেখে যেন শতো রাজ্যের সুখ এসে আমার মধ্যে ভির করল।ওকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম যে কেনো ও এই কয়দিন আমার সামনে আসেনি,তবুও চুপ করে থাকলাম।
-এই যে ম্যাম, এই কয়দিন কেমন কাটালে??
-অনেক ভালো আর আপনার মুখ না দেখাতে আরও অনেক ভালো ছিলাম।
-হুমম, সেটা আমি খুব ভালোই জানি যে তুমি কেমন ভালো ছিলে,আমি কী আর বুঝি না??
-মানে আপনি কী বলতে চাইছেন ??
-কী ভেবেছিলে আমি এই কয়দিন তোমাকে না দেখে ছিলাম??না আমি প্রতিদিনই আসতাম তবে তোমাকে দেখা দিতাম না তোমার আড়ালে থাকতাম।আর এটাও দেখতাম তুমি আমাকে খুজছো।তোমার ওই দিশেহারা চোখ দেখে আর থাকতে পারলাম না,সামনে আসতেই হলো।
-দেখুন মিষ্টার নীল,আপনার ধারণা ভুল।একটা মানুষ সামনে আসতে আসতে হঠাৎ না আসলে তাকে খোজাই স্বাভাবিক।আমি কখনোই আপনাকে ভালোবাসিনি।
এবার নীল আমার হঠাৎ আমার হাত ধরল।তারপর বলল,,
-তুমি মুখেই বললে হবে না, তোমার মুখ বলছে তুমি আমাকে ভালোবাসো,তোমার চোখ বলছে তুমি আমাকে ভালোবাসো।
নীলের এইরকম ব্যবহার আমি সহ্য করতে পারিনি।তাই ঠাস করে ওর মুখে একটা চর দিলাম।নীল আর একটা কথা না বলে মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইল।ওর চোখ দিয়ে অঝরে পানি গড়িয়ে পড়ছে।তবে কেন জানিনা আমার বুকের ভেতরটা ফেটে চৌঁচির হয়ে যাচ্ছে।চর মারাতে হয়তো ওর মানসন্মানে আঘাত লেগেছে কিন্তু কষ্টটা হয়তো আমারই বেশি হচ্ছে।আমিও চুপচাপ দাড়িয়ে আছি।নীলকে কী বলব কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা।রাগের বশত এটা কী করে ফেললাম আমি?? সমস্ত নীরাবতা ভাঙিয়ে নীল কাদোকাদো ভাবে বলে উঠল,,
-ঠিক আছে তৃষা, আমারই ভাবনার ভুল ছিল ।আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমাকে ভালোবাসো,তাই এতো অধিকার দেখিয়েছিলাম।কিন্তু এখন আমি বুঝতে পেরেছি তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো না।আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমার সামনে আসব না,কখনোই না।তবে আমার শেষ একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে??(ওকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।তবে ও যদি আর সত্যিই আমার সামনে না আসে তবে অনেক কষ্ট হবে আমার এইটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলাম)
-জি বলেন।
-আজ সন্ধ্যাবেলাই একটা পার্টির ব্যবস্তা করেছিলাম,আমি চাই তুমি ওখানে এসো।প্লীজ তৃষা না করো না আমার এই শেষ কথাটা রাখো।
-না আমি কেনো জাবো?? আমি কিছুতেই জাবো না।
বলেই আমি পিছু ফিরে চলে আসলাম।পেছন থেকে নীল বলতে লাগল,প্লীজ তৃষা তুমি এসো আমি তোমার অপেক্ষাতেই থাকব।
বাসায় চলে আসলাম।তবে কিছুতেই আজ মনে শান্তি পাচ্ছিনা।মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে।অশান্তির মধ্য দিয়েই সারাটা দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।হুমম,নীল বলেছিলো সন্ধ্যাবেলাই পার্টিতে যেতে।ও নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করবে।হ্যাঁ,আমাকে যেতেই হবে।তাই ফ্রেশ হয়ে তারাতারি পার্টিতে চলে গেলাম।ওখানে গিয়ে দেখি নীল পাইচারি করছে।আর ওর বন্ধু প্রধান নীলের হাত ধরে বারবার ওকে বোঝাচ্ছে দেখ পাগলামী করিসনা,তৃষা আসবেনা আমি বলছি।কিন্তু নীল বলছে,না আসবে আমার বিশ্বাস তৃষা ঠিক আসবে,আমার মন বলছে।নীল প্রধানের কাছ থেকে জোড় করে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এদিকে ফিরতেই আমার দিকে তাকিয়ে পড়ল,আমাকে দেখে ওর মুখে হাসি ফুঁটে উঠল।কিন্তু আজ পার্টিতে নীলের মুখে কোনো হাসি নেই।যে ছেলেটা পার্টিতে আসলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই আজ তার চোখে পানির রেখা দেখা যাচ্ছে।মনে হচ্ছে এইটাই ওর শেষ পার্টি।ও অপলকে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে।পার্টির এক পর্যায়ে নীলের বন্ধু সোহান বলল,,এবার গান শুরু করা যাক।কিন্তু কে আগে গান শুরু করবে এই নিয়ে হলো ঝামেলা।শেষ পর্যন্ত নীলকেই সিলেক্ট করা হলো কারণ ওই পার্টিটার এ্যরেজমেন্ট করেছিল।কিছুক্ষণ পরে নীল আমার দিকে একবার তাকিয়ে গান গাওয়া শুরু করল,,
“” যদি আর আমি ফিরে নাহি আসি,তুমি আমাকে কভু ভুলে যেওনা,,হৃদয়ের মনিকোঠায় সৃতিরও পাতায় পাতায় আমারই নামে করো আলপনা,,,যদি কোনো ভুল করে থাকি,ক্ষমা করে দিয়ো,ও গো সাথী এই কামনাই আমি রাখি,,,,,,,,,””
গানটা গাওয়ার সময় নীলের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।একি যে ছেলেটা পার্টিতে এসে সবসময় অন্যের মুডকে ভালো করে দেই গান গেয়ে আজ সেইই এমন একটা গান গাইছে।ওর বন্ধুরাও অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।এবার আমিও নিজের চোখকে আটকে রাখতে পারলাম না।ওখানে আর এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে সোজা বাসায় চলে আসলাম।
আমার কেন এমন হচ্ছে নীলের জন্য?? কেন ওকে বারবার দেখতে মন চাই?? কেন ওর চোখের পানি আমাকেও কষ্ট দেই?? তাহলে কী আমিও ওকে ভালোবেসে ফেললাম?? মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন এসে জমাট বেধেছে।হুমম বুঝেছি আমিও নীলকে ভালোবাসি।না ওকে আর কষ্ট দেওয়া যাবেনা।এবার ওকে বলতেই হবে যে আমিও ওকে ভালোবাসি।……………
চলবে………………..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com