গল্পঃ ভালোবাসার শেষ পরিনিতি। লেখকঃ গোলাম মস্তফা
আমি – যদি আমি হারিয়ে যাই কোনো বৃষ্টিস্নাত রাতে?
শুভ্র – (ফোনের ওপাশ থেকে) মেকাপ করো না?
আমি – হঠাৎ এ প্রশ্ন?
শুভ্র – আরে বলো আগে ।
আমি – খুব একটা না ।
শুভ্র – যদি করেও থাকো তাহলে মেকাপ করে গালে কিন্তু ঐযে লাল মেকাপ-সেকাপ দেও সেসব দিবা না, আমার কাছে চলে আসবে ।
আমি – কেন?
শুভ্র – যাতে আমি কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে তোমার গালে লাল মেকাপ করার কষ্ট কমিয়ে দিতে পারি।
আমি – শুভ্র তোমার না আর ছেলেমানুষি গেলো না।
শুভ্র – বড্ড ভালোবাসি পুষ্প তোমায়।
__
এত্তক্ষণ আমার আর শুভ্রর মাঝে কথা হচ্ছিলো, ছেলেটা আমায় বড্ড ভালোবাসে, হয়তো একটু বেশিই ভালোবাসে। পারিবারিক ভাবে সবাই জানে আর বিষয় টা মেনেও নিয়েছে । এই ২ বছরের সম্পর্কে আমি কোনো ভুল করলে সে কখনো রাগ হতো না আমার পরে, বরং সেই ক্ষণে আমার সাথে দেখা করে চুমু দিয়ে শোধটা নিয়ে নিতো। সবটা ভালোই চলছে, তবুও মনটা আমার বড্ড অস্থির, জানিনা কি ঝড় আসতে চলেছে, আমার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, ঠিক অদ্ভুত কিনা জানি না তবে আমার কাছে অদ্ভুত, কোনো বিপদ আসলে আমি বুঝতে পারি।
— ইদানীং শরীর টাও ভালো যাচ্ছে না, দুর্বলতা, শরীরে প্রচুর ব্যথা, র্যাশ, প্রতিবার মাসিকের সময় প্রচুর রক্ত যায় । আমার আবার একটু এলার্জির সমস্যা আছে বলে ব্যাপারটা নিয়ে বেশিদূর ভাবিনি, ভেবেছি র্যাশ গুলো এলার্জি আর এজন্যই দুর্বলতা, আর ব্যাপার গুলো তেও তেমন করে ভাবিনি । তবে ইদানীং দুর্বলতা যেন খুব! রোজার মাস হওয়ার কলেজ টা বন্ধ সারাদিন বাসায় থাকি, বিছানায় পরে থাকি সারাদিন, বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘোরে, হাত পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা, যেন কেউ ছিঁড়ে খায়।
—
একদিন রাতে অসম্ভব জ্বর এলে পরদিন ডক্টর টা দেখিয়েই ফেলাই ।
কিন্তু ডক্টর যা বললো সেটা আমি কখনোই কল্পনা করতে পারিনি।
ডক্টর – পুষ্প! শোনো মানুষের জীবন হচ্ছে দু’দিনের। সৃষ্টিকর্তা যখন আমাদের এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছে সেহেতু একদিন সবারই চলে যেতে হবে, কারো আগে আর কারো পরে।
আমি- এসব কেন ডক্টর!
ডক্টর – আই এম স্যরি টু সে পুষ্প, তোমার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে, রক্তে ব্লাস্ট ৯০%, লাস্ট স্টেজ। এখন আর কিছু করা সম্ভব না।
আমার পায়ের তলায় মাটি সরে গেলো, এ কি বলছে ডক্টর? আমার কিছু হলে আমার শুভ্রর কি হবে? আর আমার স্বপ্ন? আমার যে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন তার কি হবে? বাসায় গেলাম, গিয়েই রুমের দরজা দিয়ে কাঁদলাম অনেকক্ষণ। শুভ্রটা কল দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে আমার কোনো হুশ নেই। কিছুটা সাহস জুগিয়ে মাকে সব জানালাম, বলেছিলাম শুভ্রকে কিছু বোলো না, ও শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু মা আমার শুভ্রকে সব বলে দিলো, তার দুদিন পর্যন্ত শুভ্র আর যোগাযোগ করেনি।
মাকে বললাম ‘ দেখেছো তোমায় না করেছিলাম বলতে, আমি যে কয় দিন পৃথিবীতে আছি ওর সাথে ভালো ভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি ‘
মা কিছু বলে না, মুখে কাপড় গুঁজে হু’হু করে কাঁদে, আত্মীয়পরিজন আসে সমবেদনা জানায়, হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলে শেষ চেষ্টা করতে কিন্তু সায়েন্সের স্টুডেন্ট হয়ে আমি তো বুঝি এসবে আর কিছু হবে না, শুধু শুধু টাকা নষ্ট, বরং টাকা গুলো মায়ের হাতে তুলে দেই যাতে অসময়ে কাজে লাগে, আজ ৩ দিন, হঠাৎ বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো, মা খুলে গিয়ে দেখলো শুভ্র এসেছে, এসেই সোজা আমার ঘরে, হাতে অনেকগুলো ব্যাগ, সেই সাথে আমার পছন্দের সাদা গোলাপ ।
শুভ্র এসেই আমার রুমে ঢুকে একগাদা সিঁদুরে আমার সীঁথি তে পূর্ণতা দিলো, মা কিছু বললো না, কেবলই তাকিয়ে থাকলো । শুভ্র আমার রুমের দরজা বন্ধ করেই, ব্যাগ থেকে লাল বেনারসি বের করে পরিয়ে দিলো আমায়, আমার লম্বা চুল গুলো বেনি করে তাতে বেলি দিয়ে দিলো । এবং মায়ের অনুমতি নিয়ে শুভ্র আমায় ওর বাসাতে নিয়ে গেলো, আমি শুধু হা করে চেয়েই থাকলাম।
আমি – এসবের মানে কি শুভ্র?
শুভ্র – সংসার করতে চেয়েছিলে না?
আমি – তুমি যে শেষ হয়ে যাবে আমার সাথে থাকলে, আর তো মাত্র কিছুদিন আছি আমি ।
শুভ্র – তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে নিয়ে সারাজীবন চলতে না পারলেও এসময়টুকু একটু নিজের মত ভালোবাসতে দেও পুষ্প।
আমি আর কিছুই বললাম না, মরার আগে সুখ যদি এভাবেই থাকে তবে থাকুক।
ডক্টর বলেছে আমার হাতে আর ২ মাস সময় আছে।
শুভ্র এই দুই মাস আমার প্রতিটা দিন নতুন করে উদযাপন করতো, আমি শাড়ি পরতে ভালোবাসতাম, সেজন্য সে রোজ একটা করে নতুন শাড়ি আমার জন্য আনতো, এনে নিজ হাতে পরিয়ে দিতো, আমার ইচ্ছে ছিলো একটু সমুদ্র দেখার, সেটাও পূরণ করেছে পাগল টা, সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে হাতে হাত রেখে সূর্যাস্ত ও দেখেছি, আমার জন্য কম করে হলেও নতুন নতুন ৫০ টা ডিজাইনের নূপুর এনেছে, আমার পছন্দের অন্যতম জিনিস এটা। কাঁচের চুড়িতে আমার ড্রেসিংটেবিল ভরা থাকে সমসময়। রোজ ২ টা করে আইস্ক্রিম খাওয়াতো আমায়, রিকশায় নিয়ে ঘুরতো, রাত হলে বারান্দায় গিয়ে দুজনে একসাথে চাঁদ দেখতাম, আরো কত কি! হাজারো ইনফেকশন আর অসুস্থতা কে বুঝতেই দিতো না ও।
আজ ১ মাস ২৮ দিন পর আমি শুভ্রর বুকে শুয়ে আছি।
আমি – শুভ্র তোমায় ধন্যবাদ।
শুভ্র – কেন গো?
আমি – এইযে এই ১ মাস ২৮ দিন আমার এত ইচ্ছাপূরণের কারণ হলে।
শুভ্র – আর কিছু চাই? ( শুভ্রের চোখে জল)
আমি – একটা বাচ্চা।
শুভ্র – হা করে তাকিয়ে আছে যেন তার বাকশক্তি যেন, (অবশ্য মরার দু চারদিন আগে কারো মুখ থেকে এসব শুনলে অবাক হওয়ারই কথা)
আমি – হা হা হা, মজা করেছি। এসবের ঝামেলায় আমি যেতে চাই না, হি হি হি।
শুভ্র সবটা বুঝেও কিছু বললো না কিন্তু সবটাই বুঝে ফেললো। শুভ্র আরো শক্ত করে আমায় বুকে জড়িয়ে নিলো।
—
১ বছর পরে, আমি ছবি হয়ে আছি, আগের বছর এ দিনেই শুভ্রের বুকেই আমার নিশ্বাস টা বেঁধে গিয়েছিল, পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম । আজ আমার মৃত্যুর ১ বছর যেতে না যেতে শুভ্রকে তার পরিবার বলে বিয়ে করতে, আমার নিজের মা ও এসে এ কথা বলে যায়, অবশ্য বলবেই না কেন! সারাজীবন ও একা কিভাবে থাকবে! অন্তত বুড়ো বয়সের কথা ভেবেও এখন ওর বিয়েটা করা উচিত । কিন্তু আমার পাগল শুভ্রটা অনড়! সে বিয়ে করবে না ।
—
৪ বছর পরে,
আজ শুভ্রের মেয়ের জন্মদিন, উফ! শুধু শুভ্রের নয় পুষ্পের মেয়ের ও । কি ভাবছেন ? ও বিয়ে করে নিয়েছে ? উঁহু, একদম না, গত বছর এই বাচ্চাটাকেই দত্তক নিয়েছে ও।
একটা ময়লা ড্রেনে খুঁজে পেয়েছিলো ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটাকে।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com