তিয়াসার ইচ্ছা হচ্ছে,হাতের সামনে যাই কিছু পাক না কেন তাই ভেঙে দেবে
তিয়াসার ইচ্ছা হচ্ছে,হাতের সামনে যাই কিছু পাক না কেন তাই ভেঙে দেবে।মন খারাপ হলেই ও ছাদে চলে যায়।আজও তাই করলো।কিন্তু ছাদে এসেও আজ যেন রাগ কমছে না।ইচ্ছা করছে ছাদ থেকে ঝাঁপ মারতে।হঠাৎ লক্ষ পড়লো পাশের বাড়ির ছাদে ।রূপক দাঁড়িয়ে আছে।দাঁত ক্যালাচ্ছে।ওই দাঁত ক্যালানিটা দেখলেই গা জ্বলে যায় তিয়াসার।ও খানিকখন অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।কিন্তু বুজতে বাকি রইলো না রূপক এখনো ওর দিকে তাকিয়েই এখনো হাঁসছে।ওফঃ......অসহ্য।ছাদ থেকে নেমে এলো তিয়াসা।
নিজের রুমে ঢুকে বালিশে মুখ গুজে রইলো।খুব কান্না পাচ্ছিলো।মিনিট খানেক পর কাঁধে কেউ যেন হাত রাখলো।বালিশ থেকে মুখ সরিয়ে দেখলো....মা।মা বোধয় ওর সব কথা জানে।আসলে সন্তানের কোষগুলোও তো একসময় মায়েরই ছিল।তাই মায়েরা বোধয় তার সন্তানের সব খবর রাখে।তিয়াসার মাও বোধয় ব্যাতিক্রম নয়।
-কিরে,মন খারাপ?
মায়ের কথায় ভেতরের অনুভূতিটাকে ভুলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল তিয়াসা।মা বলে চললো,কি রে উত্তর দে!রূপক যাদবপুরে চান্স পেয়েছে বলে মন খারাপ?
তিয়াসার মনে হলো,সুপ্ত যে অনুভূতির কথা মা জেনে ফেলেছে-সে অনুভূতিকে এর পরেও লুকিয়ে রাখাটা ঠিক নয়।হঠাৎই অবাধ্য জলের ক-ফোঁটা অজান্তেই ওর চোখের বাইরে এসে জমা হয়েছে।মা ওর পাশে বসলেন।মাথায় হাত বুলিয়র বললেন,এই শোন যাদবপুরে চান্স পাসনি তো কি হয়েছে,ভালো সরকারি কলেজ কি শেষ হয়ে গেছে?নিশ্চই কোনো ভালো সরকারি কলেজে চান্স পেয়ে যাবি।তাই না!
তিয়াসার মনে হয় মায়ের কণ্ঠে বোধয় জাদু আছে।অগোছালো মনটাকে বারবার স্বাভাবিক করে দেয় মায়ের কথাগুলো।আর কোনো কথা না বলেই মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তিয়াসা।
তিয়াসা রূপককে চেনে সেই ছেলেবেলা থেকে।ওদের মধ্যেকার ঝগড়াটাও এক্কেবারে ছোট থেকেই।রূপক বরাবরই শান্ত ছেলে।তেমনই তিয়াসা তার ঠিক উল্টো।দস্যি বলতে যা বোঝায়-ঠিক তাই।তিয়াসার বয়স তখন কত,ছয় হবে।মায়ের কাছে মাটির পুতুল গড়া শিখে অদ্ভুত অবয়বের চারটে পুতুল বানিয়ে সুকাতে দিয়েছিল রোদে।আর রূপক অজান্তেই পা দিয়ে সেগুলোকে এক্কেবারে থেবড়ে দিয়েছিল।তাই দেখে তিয়াসাও ভ্যা করে কেঁদে উঠে কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে কিল,ঘুসি,খিমচি ইত্যাদি যত রকমের ফাইট জানা ছিল-তা রূপকের উপর প্রয়োগ করলো।হতভম্ব রূপক ওই কুড়ি সেকেন্ডে তিয়াসার কিল-ঘুসিগুলো একসেপ্ট করে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো।এমত অবস্থায় দুজনের গগনভেদী কান্না-কলরবে দু বাড়ির অন্যান্য বড়রা ছুটে এলো।তারপর দুজনের কাছ থেকে সব শুনে তারা হাঁসবে না রাগ দেখাবে এটা ঠিক করতে পারলো না।তারপর দুজনেই নিজেদের মায়ের কাছে এক প্রস্থ করে মার খেলো।রূপক খেল তিয়াসার নরম সন্দেশের মত অদ্ভুত আকৃতি বিশিষ্ট পুতুল গুলো থেবড়ে দেওয়ার জন্য আর আর তিয়াসা খেল রূপককে মারার জন্য।স্বভাবতই দুজনের মনে দুজনের প্রতি তীব্র একটা রাগের উৎপত্তি হয়েছিল।তারপর সেটা ক্রমশ বাড়তেই থাকলো।
দুজনেরই স্কুল এক।তার উপর প্রত্যেক বছর রূপক টপার,আর তিয়াসা প্রতিবারই সেকেন্ড।আগুনে ঘি পড়লো।রাগের সাথে এসে যুক্ত হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর হিংসা।বলাবাহুল্য এগুলো রূপকের তুলনায় তিয়াসারি বেশি ছিল।তারপর শৈশব কেটে কৈশর-কোনো পরিবর্তন হলোনা এসবের।
দুজনেরই ছোটবেলাকার ইচ্ছা-ইঞ্জিনিয়ারিং।তিয়াসার জয়েন্ট প্রিপারেশন ভালোই ছিল।কিন্তু ভগবান বোধয় কিছু অন্যই চেয়েছিল বোধয়।অংকের বিভাগে একটা অংক সময় খেয়ে নেওয়ার জন্য বেশ সমস্যায় পরেগেল ও।তাই অংক বিভাগটা খারাপ হয়েছিল।ফলে আশানুরূপ ,জয়েন্টে তিয়াসার রাঙ্ক রূপকের থেকে বেশ বেশি।খুব ইচ্ছা ছিলো তিয়াসার টপ রাঙ্ক কলেজগুলোর মধ্যে যে কোনো একটাটে চান্স নেবার।কিন্তু যে রেসাল্ট তিয়াসা করেছে,তাতে ভালো সরকারী কলেজে চান্স পেলেও-টপ রাঙ্কের কোনো কলেজে চান্স হবেনা বলেই মনে হয়।আজ যেন নিজেকে হেরো মনে হচ্ছে তিয়াসার।বিশেষ করে রূপকের ওই গা-জ্বালানো হাঁসিটা দেখলে।
নাহঃ......ভাগ্য বোধয় সহায় ছিল তিয়াসার।টপ রাঙ্কের কলেজেই ভর্তি হয়েছে ও।রূপকের খবর জানে না।ওর খবর আর রাখতেও চায়না তিয়াসা।
কলেজের প্রথম দিন।অন্যদের সাথে তিয়াসাও স্যারের কথা শুনছিলো মন দিয়ে।স্যার বলছিলেন-ইঞ্জিনিরিং কী?কেনই বা পরবে।হঠাৎই-'মে আই কামিং স্যার?'সব্বাই দরজার দিকে তাকালো।তবে তিয়াসা অবাক হলো।রূপক!....রূপক এখানে কি করছে!ওর তো আরও ভালো কলেজে চান্স পাবার কথা।
-'হুম কামিং।বাট হোয়াটস হ্যাপেন্ড।'
হাঁসি মুখে ভেতরে ঢুকে রূপক বললো,আসলে স্যার....প্রথম দিন তো।এমনিতেই একটু দেরি করে এসেছি,তারপরে আবার এই ক্লাসরুম টা খুঁজতে দেরি হয়ে গেল।
-ওকে,টেক ইয়োর সিট।
হেলে দুলে তিয়াসার পাশেই ধপ করে বসে পড়লো রূপক।তারপরে সেই গা জ্বালানো হাঁসিটা আবার দিলো।
ক্লাস শেষ হয়ে গেছে।স্যার বেরিয়ে গেছেন মিনিট খানেক আগে।একে-একে অন্য স্টুডেন্টরাও বেরিয়ে গেল।তিয়াসাও উঠবার উপক্রম করা মাত্র,হাত ধরে বসিয়ে দিলো ওকে রূপক।জিজ্ঞাসু চোখে তিয়াসা ওর দিকে তাকালো।তারপর মিনিট খানেক দুজনেই চুপ।অবশেষে তিয়াসাই প্রথম কথা বললো, অন্যদিকে তাকিয়ে।
- আরো ভালো জায়গায় চান্স পেতে পারতি।
আমার জন্য হঠাৎ এখানে!
-আসলে তোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে,আমার কাছে আই আই টি খড়গপুরও ফিকে।
-কিন্তু তুই তো আজ আমার পুতুল নষ্ট করিস নি।তো আমি তোর উপর রাগ করবো কেন?আর তোর প্রতিদ্বন্দ্বীই বা হবো কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর রূপক দিলো না।সব উত্তর জানা থাকলেও দেওয়া যায় না।ও কেবল হাঁসলো একটু।তিয়াসা হঠাৎ বলে উঠলো,এই ও ভাবে হাঁসিস না তো।বিরক্ত লাগে।
রূপক হাসির পরিমানটা বাড়িয়ে বললো,যাক তুইও তাহলে পছন্দ করিস আমায়।তিয়াসা গম্ভীর মুখে বললো,কেন রে?তোর মধ্যে পছন্দ করার কি আছে!
এরও জবাব দিলনা রূপক।খানিক খন বসে রইলো হাসি মুখে।বুজতেই পেরেছে সে,এ পাহাড়ি ঝর্নাকে কাবু করতে তাকেও বেশ শক্তিশালী হতে হবে।রূপক এবার টু- দি পয়েন্টেই শুরু করলো,এই তোর নাম্বার টা দে তো।
-কেন?
-বাঃ রে,তোকে পটাতে হবে না।
তিয়াসা হেসে উঠলো।বললো,বাড়ি গিয়ে ছাদ থেকে চেষ্টা করতে পারিস।পটাতে পারবি বলে মনে হয়।
নাহঃ...এই মুহূর্তে তিয়াসা আর সেই পুরোনো রূপক টাকে খুঁজে পাচ্ছে না।এই নতুন রূপককে ওর বেশ ভালো লাগছে।বেশ মনে হচ্ছে.....রূপক ই ওর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী।
-----সমাপ্ত
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com